হাওরের দুর্দশা বর্ণনা করে ‘বছরব্যাপী সহায়তা’ চাইলেন জয়া

হাওর অঞ্চলের মানুষের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে তাদের জন্য আগামী বছরের ফসল না ওঠা পর্যন্ত সহায়তা অব্যাহত রাখার দাবি জানিয়েছেন সেখানকার একটি আসনের সংসদ সদস্য জয়া সেনগুপ্ত।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 April 2017, 03:56 PM
Updated : 26 April 2017, 03:56 PM

তার সংসদীয় এলাকার সুনামগঞ্জের দিরাই ও শাল্লা উপজেলার জন্য ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র দেওয়ার কথা জানিয়ে এই জনপ্রতিনিধি বলেন, “আমরা বলেছি, আগামী ফসল না ওঠা পর্যন্ত ওই এলাকার মানুষের জন্য সামনে কোনো উপায় নাই। বাকি এগার মাস যেন তাকে খাদ্যশস্য সরবরাহ করা হয়।”

বুধবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিনিটেত ব্র্যাক আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গ্র্যাচুয়িটি রিলিফ ও খোলা বাজারে চাল বিক্রি বাড়ানোরও দাবি জানান জয়া সেনগুপ্ত।

তিনি বলেন, “খোলা বাজারে চাল বিক্রির জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে ডিলার যেন দেওয়া হয়। ত্রাণ সহায়তা কখন, সাহায্য কোথায় কখন দেওয়া হবে, সেটা যেন আগেই যেন বলে দেওয়া হয়।”

আওয়ামী লীগের সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই-শাল্লা) আসনে গত ৩০ মার্চের উপ-নির্বাচনে বিজয়ী হন তার স্ত্রী জয়া সেনগুপ্ত।

নির্বাচিত হওয়ার হওয়ার দুইদিনের মাথায় এলাকার মানুষের ওপর প্রাকৃতিক দুর্ভোগ নেমে আসায় নিজেকে ‘দুর্ভাগা’ সাংসদ হিসেবে আখ্যায়িত করে বক্তব্য শুরু করেন ব্র্যাকেরই সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা জয়া।

দিরাই উপজেলার ২ লাখ ৪৩ হাজার ৬৯০ জনগোষ্ঠীর ১ লাখ ৭২ হাজার জন এবং শাল্লায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১২ জনের মধ্যে ১ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান জয়া।

তিনি বলেন, দিরাইয়ে কৃষিযোগ্য জমি আছে ৪০ হাজার ৫৭০ হেক্টর, এর মধ্যে ২০ হাজার হেক্টরই পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে। বাঁধের বাইরে কিছু জমিতেও বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হওয়ায় কৃষক সেটিও ঘরে তুলতে পারবে না। যার ফলে ২৯ হাজার ৮২৩ লাখ টাকা মূল্যের ৮০ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন ধান নষ্ট হবে।

একই সঙ্গে শাল্লায় কৃষিযোগ্য জমি ২২ হাজার হেক্টরের মধ্যে ১৮ হাজার ১৬০ হেক্টরের ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “৭৮ হাজার ৮৮ মেট্রিক টন শস্য নষ্ট হয়েছে, যার পরিমাণ দাঁড়াবে ২৯ হাজার ৫৫৬ লাখ টাকা।”

জয়া বলেন, “শুধু এখানে শেষ নয়, সম্পূর্ণ ফসল নষ্ট হওয়ার পর অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া এবং পিএইচ লেভেল বাড়ায় সেখানে আর কোনো জলজ প্রাণী বাস করার যোগ্যতা নেই। ফলে দ্বিতীয় উপার্জনের উৎস মৎস্য সম্পদ আহরণের সুযোগও নষ্ট হয়ে গেছে।”

হাওর রক্ষায় নির্মিত বাঁধ নির্মাণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ব্যবস্থাপনা ‘ত্রুটিমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক নয়’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এ কারণে ত্রুটি থেকে গেছে।

“আরেকটি কারণ হচ্ছে সুরমা এবং কুশিয়ারা পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। যার ফলে অল্প একটু পানি হলেই ভেসে যায় দুইকূল। কখনও এতো বেশি প্লাবন হয় যে, বাঁধগুলো সেটা ধরে রাখতে পারে না। অতিপ্লাবিত হয়ে ভেসে যায় ফসল।”

একমাত্র বোরো ফসলের দেশ, এ কারণে কৃষকের দুঃখ দুর্দশার সীমা থাকে না। যদি ফসলহানি হয়।

এ বছরের পরিস্থিতি ভয়াবহতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এবার কেবল থোড় বেরিয়েছিল, তখনই অকাল বন্যা আসায় সম্পূর্ণ ফসল বিনষ্ট হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ হচ্ছে গো-সম্পদ, ছাগল সম্পদের জন্য। খাবারের অভাবে তারা একেবারে বিক্রি করে দিচ্ছে, সেটা কখনও ভাবা যেত না।

“শুধু তাই না, হাওর অঞ্চলে অনেকে হাঁস পালে, ডিম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে; হাঁসও মরতে শুরু করেছে। হাঁসের জন্য যে খাবার... তারা পানি থেকে সংগ্রহ করে, সেটাও তারা পাচ্ছে না।”

হাওর এলাকার জনগোষ্ঠী ফসল ফলানোর জন্য সুদে টাকা নেওয়ার প্রসঙ্গে জয়া সেনগুপ্ত বলেন, “গত বছর তারা ৫০ শতাংশ ফসল ঘরে তুলেছিল, এ কারণে সে সুদ শোধ করতে পারেনি। এ বছর তারা আবার সুদে টাকা নিয়ে ফসল লাগিয়েছিল, সেটা শোধ করার সুযোগ নাই। সুতরাং আপনারা বুঝতেই পারেন, তাদের সুদের পরিমাণ কতটুকু বেড়েছে।”

সংবাদ সম্মেলনে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম এবং সুনামগঞ্জের শাল্লার বাহারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে না হওয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। উপজেলা সদর থেকে ত্রাণ বিতরণের কারণে মানুষ সারাদিন দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে থেকে বিকালে খালি হাতে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে অষ্টগ্রামের চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ বলেন, “মানুষের কান্না ছাড়া এখন আমার এলাকায় আর কিছু নেই। যে কৃষক ১ থেকে ২ হাজার মণ ঘরে তুলতো, তার পাঁচ কেজি চালও নেই। মাসে ৩০ কেজি চাল দিয়ে কি আর পরিবার চালানো সম্ভব?”

তিনি বলেন, “সেই ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে উপজেলা শহর থেকে। দেখা যায়, হাওরের দীর্ঘ এলাকা পাড়ি দিয়ে সকালে এসে এক থেকে দেড় হাজার মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে; আর বিকেলে তাদের ৫০০ জন হয়তো ত্রাণ পেল। এ কারণে ওয়ার্ড পর্যায়ে বিতরণ কার্যক্রম বিস্তৃত করা দরকার। হাওর অঞ্চলের দুরত্ব বিবেচনা করে আগে থেকে জানিয়ে দেওয়া উচিত।”

বাহারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিধান চন্দ্র চৌধুরী বলেন, হাওর এলাকার মানুষের সহায়তার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত। শুধু ৩০ কেজি চাল দিয়ে মাসে একটি পরিবারের কিছু হয় না। তার সঙ্গে চাল-ডাল-তেলসহ অন্যান্য দ্রব্যও দেওয়া দরকার।

হাওর অঞ্চলের মানুষ সর্বমুখী দুর্ভোগের মুখোমুখি হয়েছে মন্তব্য করে ব্র্যাকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির পরিচালক গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, “সরকার ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছে, এটাকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনা দরকার।”

তিনি বলেন, “মে’র মাঝামাঝি সময়ে মানুষের ঘরে ফসল তোলার কথা, কিন্তু তার আগেই সব শেষ হয়েছে, এটা ঠিক। তবে সময়ের হিসাবে আগামী ২-৩ সপ্তাহ তাদের ঘরে খাদ্যশস্য থাকার কথা। এই সময়টা আমাদের জন্য গ্রেস পিরিওড। এর মধ্যে সবকিছু ঠিকঠাক করতে হবে।”

সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন হাওর এলাকার বেসরকারি সংস্থা ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট অ্যাফেয়ার্সের নির্বাহী পরিচালক নাজমুল হক।

অন্যদের মধ্যে সেখানকার চেতনা পরিবেশ মানব উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মুসা বক্তব্য দেন।