জেএমবির ‘আইইডি বিশেষজ্ঞ’ বুয়েট ছাত্র গ্রেপ্তার

জেএমবির ‘সারোয়ার-তামিম গ্রুপের’ এক ‘বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞকে’ গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলে জানিয়েছে র‌্যাব।

লিটন হায়দার অপরাধ বিষয়ক প্রধান প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 April 2017, 06:25 AM
Updated : 26 April 2017, 07:36 PM

র‌্যাব-১০ এর কোম্পানি কমান্ডার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন ফারুকী জানান, বুধবার সকালে রাজধানীর উত্তরার একটি বাসা থেকে মুশফিকুর রহমান ওরফে মুশফিক মার্টিন ওরফে জেনি নামে ৩০ বছর বয়সী ওই যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়।

জেনি আইইডির (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ জানিয়ে মহিউদ্দিন ফারুকী বলেন, তার কাছে বিপুল পরিমাণ দূর নিয়ন্ত্রিত আইইডি এবং বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম পাওয়া গেছে।

র‌্যাবের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জেনি ২০০৫ সালে বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে ভর্তি হলেও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে আর ডিগ্রি শেষ করতে পারেননি।

তবে মাঝে মাঝে বিভিন্ন কোর্স নিয়ে তিনি ঠিকই ছাত্রত্ব টিকিয়ে রেখেছেন। এখনও কাগজে কলমে তিনি বুয়েটের শেষ বর্ষের ছাত্র বলে র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান।   

তারা বলছেন, জেনির বাবা রফিকুল ইসলাম একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। জেনির আরও এক ভাই ও এক বোন রয়েছেন।

র‌্যাবের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২০ মার্চ ঢাকার বাড্ডা এলাকায় এক অভিযানে বেশ কিছু দেশীয় অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় ওই নাশকতা পরিকল্পনার অভিযোগে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে থানায় মামলাও করা হয়।

ওই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে জেএমবির সারোয়ার-তামিম গ্রুপের ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, যাদের জবানবন্দিতে মুশফিকুর রহমান জেনির নাম আসে।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জেনিই জেএমবি সদস্যদের আইইডি সরবরাহ করে আসছিলেন বলে আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে জানান গ্রেপ্তার জঙ্গিরা।

২০১৫ সালে এবং ২০১৬ সালের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ছুরি চাপাতি ব্যবহার করে একের পর এক জঙ্গি হামলা চালানো হলেও গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলায় জঙ্গিরা ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইডি) ব্যবহার করেছিল বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্য।

এরপর চলতি বছরের শুরুতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, সিলেটের দক্ষিণ সুরমা এবং মৌলভীবাজারের জঙ্গিদের আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের সময় শক্তিশালী আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। বেশ কিছু বোমা, গ্রেনেড ও সুইসাইড ভেস্টের পাশাপাশি বিস্ফোরক জেল ও বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিকও উদ্ধার করা হয়।

র‌্যাব বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে জেএমবির এই অংশের নাশকতার পরিকল্পনা, ঘটনাস্থল রেকি করা এবং দূর নিয়ন্ত্রিত আইইডি বসানোর কাজ জেনির ‘নেতৃত্ব ও তত্ত্বাবধানেই’ চলছিল।

বাড্ডার ঘটনায় গ্রেপ্তারদের মধ্যে ওয়ালী জামান ও আনোয়ার নামে জেএমবির ‘সারোয়ার-তামিম গ্রুপের’ দুই সদস্য ছিলেন, যারা জেনির সহপাঠী ও সহযোগী বলে র‌্যাবের  ভাষ্য।

জেনিকে বিকালে আদালতে হাজির করে বাড্ডা থানার ওই সন্ত্রাস দমন আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হলে বিচারক তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন।

মায়ের দাবি, মুশফিককে ধরা হয় দুদিন আগে

মুশফিককে দুই দিন আগেই র‌্যাব গ্রেপ্তার করে বলে দাবি করেছেন তার মা রাশিদা ইসলাম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সোমবার রাত ১১টায় র‌্যাব ধরে নিয়ে যায়। আজ (বুধবার) সকালে তাকে বাসায় নিয়ে আসে এবং কিছুক্ষণ অবস্থানের পর আবার নিয়ে যায়। নিয়ে যাওয়ার আগে তাকে গোসল করায় এবং কাপড় বদলে নেয়।”

এই বিষয়ে র‌্যাব-১০ এর অধিনায়ক জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জেএমবির সারোয়ার- তামিম গ্রুপের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই মুশফিকের নাম পাওয়া যায়।

“তাকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালাতে গিয়ে পাওয়া যায়নি। তবে নজরদারি ছিল। বাসায় অবস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর আজ সকালে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।”

নিজের কক্ষে ছড়িয়ে থাকা নানা ইলেকট্রিক সরঞ্জামের ছবি মুশফিকের ফেইসবুক পাতায় রয়েছে

বুয়েটের ছাত্র মুশফিক কিছুদিন আগে ঢাকার বাইরে পরীক্ষামূলক একটি সফল আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে বলে র‌্যাবের দাবি।

জাহাঙ্গীর মাতুব্বর বলেন, “প্রায় একশ মিটার দুর থেকে এই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে মুশফিক। এসময় তার সাথে বেশ কয়েকজন সহযোগী ছিল, যাদের কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছে।” 

এই পরীক্ষামূলক সফলতার পর রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের পাশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান করে এমন একটি ভবন গানপাউডারসহ বিভিন্ন ডিভাইস দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাও তারা করেছিল বলে র‌্যাব কর্মকর্তাদের দাবি।

তবে রাশিদা বলেন, মুশফিকের বন্ধু বুয়েটের কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের আনোয়ার তাকে ‘ব্ল্যাকমেইল’ করেছে।

“মুশফিককে দিয়ে কিছু ডায়াগ্রাম বানিয়ে নিয়েছে। সরল বিশ্বাসে মুশফিক বানিয়ে দেয়। এগুলোর জন্য টাকা দিতে চাইলেও সে নেয়নি।”

গত ২০ মার্চ আনোয়ার বাড্ডা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন।

গিটারিস্ট মুশফিকের বদলে যাওয়া

মুশফিককে একজন সংস্কৃতিমনা তরুণ হিসেবেই দেখত তার পরিবার। তার ফেইবুক পাতায় গিটার হাতে তার ছবিও দেখা যায়।

সেই মুশফিককে জঙ্গি হিসেবে মানতে পারছেন না মা রাশিদা।

তিনি বলেন, “মুশফিক গিটার বাজাতো। বিভিন্ন ব্যান্ডের সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। জঙ্গির সাথে তার কোনো সম্পর্ক নাই। সে কখনও নামাজও পড়ত না।”

গিটার হাতে মুশফিকের এই ছবি রয়েছে তার ফেইসবুক পাতায়

দুই ভাই এক বোনের মধ্যে মুশফিক মেজ। তার বড় ভাই একজন ডিপ্লোমা কম্পিউটার প্রকৌশলী। ছোট বোন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শিক্ষার্থী।

তাদের বাবা রফিকুল ইসলাম ১৯৯৮ সালে মারা গেছেন। তিনিও বুয়েট থেকে পাস করা প্রকৌশলী ছিলেন।

প্রকৌশলী রফিকুল মতিঝিলসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ ভবনের নকশা করেছেন বলে তার বড় ছেলে জানান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান স্টেডিয়ামের পাশে বিডিবিএল (সাবেক শিল্প ব্যাংক ভবন) ভবনটির নকশা আমার বাবার করা।”

মুশফিক গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর কলেজ অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভে (কোডা) ভর্তি হয়। সেখান থেকে এইচএসসি পাস করার পর বুয়েটে পড়ার সুযোগ পান।

ছেলের শিক্ষাজীবনে ছেদের বিষয়ে তার মা বলেন, মুশফিক তার বিষয় নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তড়িৎ কৌশলেই আগ্রহ বেশি ছিল তার।

র‌্যাব জানায়, মুশফিককে গ্রেপ্তারের সময় তার কাছ থেকে বেশ কিছু আইইডি, ইলেকট্রিক সরঞ্জাম, রিমোট কন্ট্রোল উদ্ধার করা হয়েছে।

মুশফিকের মা বলেন, যেগুলো উদ্ধার করেছে সেগুলো তার ছেলের পড়া সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সামগ্রী। ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চর্চা করতেন তিনি। সর্বশেষ সে পানির মিটার নিয়ে কাজ করছে।

নিজের ঘরের দরজায় মুশফিক ‘ল্যাব’ লিখে রেখেছিলেন জানিয়ে রাশিদা বলেন, “ঘরে সে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চর্চা করত। বিজ্ঞানের নানা ধরনের জিনিস বানানোর চেষ্টা করত। কিছুদিন আগে ঢাকার বাইরে রাঙামাটিতে গিয়ে চোর ধরার একটি প্রজেক্ট করে প্রশংসিত হয়।”

র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, মুশফিক যে জঙ্গি তৎপরদায় জড়িয়ে পড়েছিলেন, তা তার পরিবারের সদস্যরা আচ করতে পেরেছিলেন।

“মুশফিক তার গ্রুপের সদস্যদের আইইডি সরবরাহসহ বড় ধরনের নাশকতা ঘটানোর জন্য জঙ্গিদের উদ্বুদ্ধ করত, তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আরও তথ্য পাওয়া যাবে,” বলেন র‌্যাব-১০ এর অধিনায়ক জাহাঙ্গীর মাতুব্বর।

মুশফিকের ধর্ম পালনের বালাই ছিল না দাবি করলেও তার মা রাশিদা বলেছেন, র‌্যাব গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার সময় মুশফিক বলেছে যে তাকে ‘মেরে ফেললে সে বেহেস্তে চলে যাবে’।