রানা প্লাজা: থমকে আছে বিচার

বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনার পর চার বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার পায়নি নিহত সহস্রাধিক শ্রমিকের পরিবার।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 April 2017, 04:34 AM
Updated : 24 April 2017, 06:31 AM

ওই ঘটনার পর দায়ের করা তিনটি মামলার মধ্যে হত্যা এবং ইমারত বিধির মামলায় অভিযোগ গঠন হলেও থমকে আছে সাক্ষ্যগ্রহণ। আর দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের অন্য মামলায় এখনও অভিযোগ গঠনই হয়নি।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে সাভার বাসস্ট্যন্ড সংলগ্ন আট তলা রানা প্লাজা ভেঙে পড়লে শিল্পক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ দুর্ঘটনাটি ঘটে।

ওই ঘটনায় নিহত হন এক হাজার ১৩৫ জন, আহত হন আরও হাজারখানেক শ্রমিক, যারা ওই ভবনের পাঁচটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন।

বাংলাদেশের ওই ঘটনা সে সময় আন্তর্জাতিক সব গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়। দেশে কারখানার অবকাঠামোগত নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এলে সরকার ও মালিকরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়।

ভবন ধসে প্রাণহানির ঘটনায় প্রথমে ‘অবহেলাজনিত মৃত্যুর’ অভিযোগে একটি মামলা করেন সাভার থানার এসআই ওয়ালী আশরাফ। রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাসহ ২১ জনকে এজাহারে আসামি করা হয়।

তবে তদন্ত শেষে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্রে ৪১ জনকে আসামি করে তাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত মৃত্যু ঘটানোসহ দণ্ডবিধির ৩০২, ৩২৬, ৩২৫, ৩৩৭, ৩৩৮, ৪২৭, ৪৬৫, ৪৭১, ২১২, ১১৪, ১০৯, ৩৪ ধারায় বিভিন্ন অভিযোগ আনেন।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সহকারী সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর গতবছর ১ জুন ওই অভিযোগপত্র জমা দেন। 

এতে বলা হয়, রানা প্লাজায় ফাটল ধরার পর ঝুঁকি জেনেও শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। কাজ না করলে চাকরিচ্যুতির হুমকিও দেওয়া হয়েছিল বলে প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। এটা আসলে ‘ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা’।

গত বছরের ১৮ জুলাই অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ঢাকার জেলা দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান এই হত্যা মামলার বিচার শুরু করলেও এখনও সাক্ষ্যগ্রহণই শুরু করা যায়নি। 

ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবির বাবুল জানান, এ মামলার এক আসামির মৃত্যুর তথ্য তার আইনজীবী আদালতকে জানালেও সাভার থানা পুলিশ এখনও এ বিষয়ে কোনো প্রতিবেদন দেয়নি।

এদিকে আসামিদের মধ্যে সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র রেফায়েত উল্লাহ, কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম হাই কোর্টের আদেশে স্থগিত রয়েছে।

এ অবস্থায় তাদের বাদ দিয়েই মামলার বিচার এগিয়ে নেওয়া হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত না হওয়ায় বার বার পিছিয়ে যাচ্ছে সাক্ষ্যগ্রহণ। আগামী ৭ মে এ মামলার শুনানির পরবর্তী দিন রাখা আছে।

মামলার ৪১ আসামির মধ্যে ৩০ জন ইতোমধ্যে জামিন পেয়েছেন। ভবনমালিক সোহেল রানাসহ তিনজন আছেন কারাগারে; আর ৭ জন পলাতক।

 

ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক আফসানা আবেদীনের আদালতে বিচারাধীন ইমারত বিধির মামলাটিও আটকে আছে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে।

রাজউক কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনের দায়ের করা এ মামলায় রানা প্লাজার অবকাঠামো নির্মাণে ত্রুটি ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর ২০১৫ সালের ১ জুন ইমারত বিধির মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেন।

এরপর ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম মুস্তাফিজুর রহমান গতবছর ১৪ জুন ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।

কিন্তু জেলা ও দায়রা জজ আদালতে তিন আসামির করা রিভিশন আবেদন অনিষ্পন্ন থাকায় এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা যায়নি বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবির বাবুল।

নকশাবহির্ভূতভাবে রানা প্লাজা নির্মাণের অভিযোগে দুদকের করা মামলাটির অভিযোগ গঠন বিলম্বিত হয়েছে অভিযোগপত্রে ত্রুটি ও পুনঃতদন্তের কারণে।

২০১৪ সালের ১৫ জুন দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক এস এম মফিদুল ইসলাম সাভার মডেল থানায় এ মামলা করেন। ভবন মালিক সোহেল রানাকে বাদ দিয়ে ওই মামলায় তার বাবা-মাসহ ১৭ জনকে আসামি করায় ব্যাপক সমালোচনা হয় সে সময়।

এরপর ২০১৪ সালের ১৬ জুলাই রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা ও দণ্ডবিধি ১০৯ ধারায় অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘রানা প্লাজা’ নামে ছয়তলা একটি শপিং কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য ২০০৬ সালের ১০ এপ্রিল নকশা অনুমোদন করে সাভার পৌরসভা। ২০০৮ সালের ২২ জানুয়ারি ওই ছয়তলা ভবনের ওপর আরও চার তলা নির্মাণের অনুমোদন চাওয়া হয়।

এরপর আগের অনুমোদনের নথির তথ্য গোপন করে নতুন নথি খুলে পৌর কর্তৃপক্ষ দশ তলা ভবনের নকশা অনুমোদন করে। তাছাড়া রানা প্লাজা নির্মাণের আগে শপিং কমপ্লেক্স করার কথা বলা হলেও পরে সেখানে পাঁচটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি স্থাপনের অনুমতি দেয় সাভার পৌরসভা।

অভিযোগ গঠনের শুনানি পর্যায়ে অভিযোগপত্রে ত্রুটি ধরা পড়লে ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালত গত বছরের ৬ মার্চ অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয়।

দুদকের আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম জানান, দুদক গত ফেব্রুয়ারিতে অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পর বিভাগীয় বিশেষ জজ এম আতোয়ার রহমান ১৯ এপ্রিল অভিযোগ গঠনের শুনানি করেন। আগামী ৮ মে এ বিষয়ে আদেশের দিন রয়েছে।

এদিকে চার বছরেও বিচারের অগ্রগতি না থাকায় সরকারের ‘আন্তরিকতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শ্রমিক অধিকার কর্মীরা।

গত রোববার ‘গার্মেন্টস শ্রমিক ও শিল্প রক্ষা জাতীয় মঞ্চ’ আয়োজিত এক মানববন্ধনে টেক্সটাইল গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফোডারেশনের সাধারণ সম্পাদক তপন সাহা বলেন, “আসামিদের মধ্যে সোহেল রানাসহ মাত্র তিনজন আটক আছে। বাকিরা জামিন নিয়ে বাইরে আছে। সরকার আন্তরিক উদ্যোগ নিলে বিচার প্রক্রিয়া অনেক আগেই শেষ হত।”