কী ঘটেছিল নিউ ওয়েভ ক্লাবে?

ঢাকার কাফরুলের নিউ ওয়েভ ক্লাবে অভিযান চালিয়ে ‘র‌্যাব পরিচয়ে মোবাইল ফোন ও টাকা কেড়ে নেওয়ার’ অভিযোগ ওঠার পর গোয়েন্দা পুলিশের ১১ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও সেখানে কী ঘটেছিল তা স্পষ্ট হয়নি। 

গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 April 2017, 04:12 PM
Updated : 20 April 2017, 04:12 PM

ক্লাব কর্তৃপক্ষ বলছে, গোয়েন্দা পুলিশের ওই দল ‘অন্যায়ভাবে’ ওই ক্লাবের লোকজনের কাছ থেকে টাকা পয়সা কেড়ে নেওয়ার পর চারজনকে আটক করেছে, এমনকি গুলি করারও হুমকি দিয়েছে।

অন্যদিকে পুলিশের দাবি, তারা সেখান থেকে মাদক উদ্ধার করেছে এবং তাদের অভিযানে অন্যায় কিছু ছিল না। আটকদের মধ্যে একজন সেনা কর্মকর্তার স্বামী থাকায় তারা পরিস্থিতি ‘জটিল’ করে তুলেছে।

তবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) কর্মকর্তারা।

গোয়েন্দা পুলিশের ওই দলটি মঙ্গলবার রাতে সাধারণ পোশাকে ‘নিউ ওয়েভ’ ক্লাবে যায়। ১১ জনের ওই দলের নেতৃত্বে ছিলেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার দলের সহকারী কমিশনার রুহুল আমিন।

সেখান থেকে তারা চারজনকে আটক করে ফেরার পথে কাফরুলে সেনানিবাসের চেকপোস্টে  মিলিটারি পুলিশ গাড়ি থামায়। পরে ওই চারজনকে ছেড়ে দিয়ে ডিবির ১১ সদস্যকে পাঠানো হয় কাফরুল থানায়।

ঘটনা মঙ্গলবার রাতের হলেও বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে আসে একদিন পর। এর মধ্যে সহকারী কমিশনার রুহুল আমিনসহ ওই অভিযানে অংশ নেওয়া সবাইকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বিষয়টি তদন্তের জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি করে দেন ঢাকার পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া।

কার কথা ঠিক জানি না’

সেদিন নিউ ওয়েভে কী ঘটেছিল জানতে চাইলে আছাদুজ্জামান মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে তারা (ডিবি) ওখানে অন্যায়ভাবে অভিযান করে নিরীহ লোকজনকে ধরেছে। আর ডিবির বক্তব্য হল, তারা কোনো অন্যায় করতে যায়নি। তারা বিধি মোতাবেক গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ওইখানে মাদক ও অস্ত্র আছে খবর পেয়ে অভিযান পরিচালনা করেছিল।

“কিন্তু সেনাবাহিনী তাদের আটকেছে, কারণ সেখানে সেনাবাহিনীর মেজর তানিয়া নামের একজনের স্বামী ছিলেন। যে কারণে তারা ডিবির ওই টিমকে আটকে পরিস্থিতি জটিল করে পুলিশকে হ্যান্ডওভার করেছে।”

পুলিশ কমিশনার বলেন, অভিযানে ওই ক্লাব থেকে ইয়াবা উদ্ধারের কথা বলেছে গোয়েন্দা পুলিশ।

“তারা বলছে, ওইখানে অস্ত্র ব্যবসা হয়, ইয়াবা ব্যবসা হয় ও নানান ধরনের বিতর্কিত লোকজন সেখানে এসে নানান অপরাধ করে।”

আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, “কার বক্তব্য ঠিক আমি জানি না। আমি সবাইকে সাসপেন্ড করে তিন সদস্যের একটি কমিটি করে দিয়েছি। ওই কমিটি তিন কর্মদিবসের মধ্যে সমস্ত ধরনের তথ্য প্রমাণ, সাক্ষ্য যাচাই বাছাই করে দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করবে।”

তিনি বলেন, গোয়েন্দা পুলিশের ওই দলটি কী উদ্দেশ্যে সেখানে গিয়েছিল, তারা আইন ভেঙেছিল কি না, কোনো ত্রুটি বিচ্যুতি ছিল কিনা- সব খতিয়ে দেখা হবে তদন্তে।

মহানগর পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার মাসুদ আহমেদ, গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার জামিল আহমেদ ও পুলিশ সদর দপ্তরের যুগ্ম কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় এই কমিটির সদস্য।

“রিপোর্টের ভিত্তিতে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেউ ছাড় পাবে না,” বলেন আছাদুজ্জামান মিয়া।

যাদের বরখাস্ত করা হয়েছে, তাদের মধ্যে সহকারী কমিশনার রুহুল আমিন, পরিদর্শক গিয়াস উদ্দিন, এসআই জাহিদুল ইসলাম এবং এএসআই লুৎফুর রহমান, মাহাবুবুর রহমান ও তোফাজ্জল হোসেনের নাম জানা গেছে।

তবে পুলিশ কমিশনার বলেন, “সাসপেন্ড অর্থ পানিশমেন্ট না। তারা যেন তদন্তকে প্রভাবিত করতে না পারে- সেজন্যই এ ব্যবস্থা।”

‘আগেও ঘটেছে একই ঘটনা’

কাফরুলের ইব্রাহিমপুর রোডে একটি পাঁচতলা ভবনের চতুর্থ তলায় ২০০৫ সালে ‘নিউ ওয়েভ’ ক্লাব চালু হয়।

ওই ভবনে একটি চায়নিজ রোস্তারাঁ আছে; একটা ফ্লোরে আছে নাচ শেখার ব্যবস্থা।

ক্লাবের সভাপতি শফিউল আজম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সেখানে এলাকার লোকজন বিলিয়ার্ড খেলে, কেউ কেউ জিম করতে যান। সেখানে ‘অবৈধ কিছু হয় না’।

শফিউল বলছেন, সেদিন তিনি ক্লাবে ছিলেন না, পরে গিয়ে সদস্যদের কাছে ঘটনার বিবরণ শুনেছেন।

“সেদিন রাতে ১০/১২ জন লোক এসে পুলিশ, আর্মি ও র‌্যাবের পরিচয় দেয়। তারা হুমকি দেয়, কোনো কথা বললে গুলি করে দেবে। জিম করছিল, বিলিয়ার্ড খেলছিল- এমন ২০/২৫ জনকে ডেকে একটা রুমে নিয়ে তারা সবার মোবাইল, মানিব্যাগ টেবিলে রাখতে বলে। পরে সেখান থেকে টাকা নিয়ে মোবাইল ফোন একটা ব্যাগে ভরে বলে লোকজনের কাছে জেনেছি।”

সেখানে থাকা ব্যক্তিদের বরাত দিয়ে ক্লাব সভাপতি বলেন, অভিযানে আসা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পরে সবার শরীর তল্লাশি করে কারও কাছে আর কোনো টাকা পাওয়া গেলে গুলি করে দেওয়ার হুমকি দেয়।

“সেখানে যারা দুই একজন পরিচয় জানতে চেয়েছিল, তাদের হাতকড়া পড়ায়। এরপর তাদের নিয়ে তারা চলে যায়।”

পরে ওই ক্লাব থেকে র‌্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়, র‌্যাবের কোনো দল সেখানে অভিযানে যায়নি।

শফিউল বলেন, গত ১৬ মার্চও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। সেদিন ২০/২৫ জনের টাকা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে।

“ক্লাবের সিসিটিভি ফুটেজে দেখেছি, সেদিন যারা এসেছিল তাদের কয়েকজন মঙ্গলবারও ছিল। ওই ঘটনাটি আমরা কাফরুল থানা পুলিশকেও জানিয়েছিলাম।”

কাফরুল থানার ওসি শিকদার মো. শামীম জানান, মঙ্গলবার রাতের ঘটনা নিয়ে তার থানায় কোনো মামলা হয়নি। মার্চে একইরকম ঘটনার বিষয়ে কোনো লিখিত অভিযোগও ক্লাব কর্তৃপক্ষ করেনি।  

‘এখতিয়ার বহির্ভূত অভিযান’

পুলিশ কমিশনার ‘তদন্তের স্বার্থে’ অভিযানকারী ১১ ডিবি সদস্যকে সাময়িক বরখাস্তের কথা বললেও মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন বলেছেন অন্য কথা।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দায়িত্বে থাকা ওই দলটির মাদকবিরোধী অভিযানের ‘জুরিসডিকশন’ ছিল না জানিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এজন্য তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”

র‌্যাব পরিচয়ে টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “ডিবির লোক তো অন্য কোনো বাহিনীর পরিচয় দেওয়ার দরকার নেই। তাদের তো নিজেদেরই পরিচয় আছে।”

ওই ক্লাবে অভিযানের নেতৃত্বে থাকা সহকারী কমিশনার রুহুল আমিন তদন্তাধীন বিষয়ে বেশি কথা বলতে না চাইলেও অভিযানের এখতিয়ার নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ডিবি সারা বাংলাদেশে অপারেশন করে। যশোর, নড়াইল কি আমাদের জোন? সেখানেও তো আমরা কাজ করি। এখানে তো আইনগত কোনো বাধা নেই।”