বিচার বিভাগের সঙ্গে দ্বন্দ্ব কাম্য নয়: প্রধানমন্ত্রী

বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের দূরত্ব সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে বলে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব অপ্রত্যাশিত বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 April 2017, 09:04 AM
Updated : 15 April 2017, 10:38 AM

রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে সমন্বয় থাকার উপর জোর দিয়ে সরকার প্রধান বলেছেন, “একে অপরের সম্পূরক হিসাবেই কাজ করবে। একে অপরকে অতিক্রম করে না. এখানে ক্ষমতার শক্তি দেখিয়ে না..

“ক্ষমতা কারও কিন্তু কম নয়। এখন কে কাকে সম্মান করবে, কে কাকে করবে না, কে কার সিদ্ধান্ত নাকচ করবে, কে কাকে মানবে, না মানবে; এই দ্বন্দ্বে যদি আমরা যাই, তাহলে কিন্তু একটি রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না।”

শনিবার রাজধানীর কাকরাইলে উচ্চ আদালতের বিচারপতির জন্য আবাসনস্থল উদ্বোধনের এই অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেন, একটি মহল সব সময় সরকার ও বিচার বিভাগের মধ্যে দূরত্ব তৈরির অপচেষ্টায় লিপ্ত। এরকম ভুল বোঝাবুঝির কারণে সাধারণ জনগণের কাছে ভুল বার্তা চলে যায়।

বিচার বিভাগ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতিকে পাশ কাটানো হয়েছে বলে উষ্মা প্রকাশ করেন তিনি।

“সম্পূর্ণ ভুল তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে সরকার প্রধানের কাছ সত্য গোপন করে, সিদ্ধান্তগুলো হাসিল করা হয়েছে। এরকম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে প্রধান বিচারপতির সাথে আলোচনা করা হলে ভুল বোঝাবুঝি হত না।”

এবিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “মাননীয় বিচারপতি কিছু প্রসঙ্গ তুলেছেন। আমি তাকে অনুরোধ করব … রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীকে নিয়োগ দেওয়া এবং বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া। এখানে কিন্তু আমার কোনো ক্ষমতা নেই।”

বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে প্রধান বিচারপতির কোনো বক্তব্য থাকলে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন সরকার প্রধান শেখ হাসিনা।

“এখানে কোনো রকম কিছু হলে এখানে রাষ্ট্রপতির সাথে আলাপ-আলোচনা করে সমাধান করাটাই ভালো। সেটা করলেই ভালো। আর, এক্ষেত্রে আমাদের যদি কিছু করণীয় থাকে, নিশ্চয়ই আমাদের পক্ষ থেকে তা দেখব।”

শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের কোনো রকম দ্বন্দ্ব না চাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এরকম হলে তা জনগণের জন্যও ভালো হবে না, বিচার বিভাগের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

“যে কোনো বিষয় হলেও সেটা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা উচিৎ এবং সেটা সেভাবেই বিবেচনা করে দেখা উচিৎ বলে আমি মনে করি।”

সংসদ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগ নিজ নিজ ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটানোর ক্ষেত্রে জনস্বার্থের বিষয়টি বিবেচনা করার উপর জোর দেন প্রধানমন্ত্রী।

জাতীয় সংসদের প্রণয়ন করা আইন উচ্চ আদালতে বাতিল করে দেওয়া নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে শেখ হাসিনা এই ধরনের ক্ষেত্রে বিচার বিভাগেরও সুবিবেচনা প্রত্যাশা করেন।

“আমরা যখন একটি আইন প্রণয়ন করি, তখন এই আইনটা দীর্ঘ পথ পরিক্রম করে আসে। আমরা হঠাৎ করে পার্লামেন্টে আইন কিন্তু পাস করি না। কোনো আইন করাই হয় কোনো না কোনো জনগণের স্বার্থে। সেই আইন যদি দেখি দুজন বসে নাকচ করে দিলেন। তারপর, আর কিছুই করার থাকল না। তাহলে, এতদিন ধরে খাটাখাটুনি .. সব ব্যর্থ হয়ে যায়।”

প্রধানমন্ত্রী বক্তব্যের শুরুতেই উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানান। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানান তিনি।

প্রধানমন্ত্রীর আগে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে প্রধান বিচারপতিও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তিন অঙ্গের ভারসাম্যের উপর জোর দেন।

তিনি বলেন, “প্রত্যেক বিভাগকে দেশের প্রচলিত আইন ও সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে থেকে দায়িত্ব পালন করতে হয়।

“কখনও কখনও দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে শীতল সম্পর্কের সৃষ্টি হতে পারে। তবে এ সম্পর্ককে ইতিবাচক দৃষ্টিতে গ্রহণ করলে প্রত্যেক বিভাগের সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটবে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রভুত কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।”

“আশা করি, বিচার বিভাগকে আপনি আপন করে দেখবেন,” প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন প্রধান বিচারপতি।

বিচারপতি সিনহা বলেন, সীমিত সম্পদ ও বাজেট সত্ত্বেও অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে বিচার ব্যবস্থা সুশৃঙ্খল এবং জনগণের সর্বোচ্চ আস্থা অর্জন করেছে।

মামলা জটকে বিচার বিভাগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে তুলে ধরে বিচারকের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি অবকাঠামোর সুবিধার নিশ্চিতের সুপারিশ করেন।

“ভারতে ১০ লাখ মানুষের জন্য ১৮ জন বিচারক হলেও, বাংলাদেশে তা মাত্র ১০ জন। এই অল্প সংখ্যক বিচারকের জন্যও অবকাঠামোগত সুবিধা নাই।”

আপিল বিভাগে বর্তমানে সাতজন এবং হাই কোর্ট বিভাগে ৮৫ জন বিচারক রয়েছে। হাই কোর্টের বিচারকদের মধ্যে তিন জন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস্ ট্রাইবুনালের দায়িত্ব পালন করছেন। চারজন বিচারক গুরুতর অসুস্থ।

এই তথ্য দিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, “ফলে বিভিন্ন সময়ে বেঞ্চ গঠনে আমাকে হিমশিম খেতে হয়। ২০১৭ সালে সাতজন বিচারক অবসর গ্রহণ করবেন। ফলে বেঞ্চ গঠনের জটিলতা আরও প্রকট হবে।”

ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চেয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, “আমরা ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প হাতে নিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে প্রকল্পটি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আমরা আশা করব, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার হস্তক্ষেপে এই বাধা দূরীভূত হবে।”

বাংলাদেশে উচ্চ আদালতের বিচারকদের প্রশিক্ষণের সুবিধা না থাকার বিষয়টি তুলে ধরে একটি পূর্ণাঙ্গ ও আধুনিক ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমি স্থাপনে কমপক্ষে ২৫ একর জমি বরাদ্দের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানান তিনি।

এই প্রসঙ্গে তিনি ভারতের ভোপালে প্রশিক্ষণের সুযোগ থাকার বিষয়টি তুলে ধরে তা স্বল্পকালীন হওয়ায় বিচারপতিদের অসন্তুষ্টির কথা জানান।

প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফরের সময়ে বিচারকদের প্রশিক্ষণে সমঝোতা স্মারক সইয়ের ক্ষেত্রে নিজের উদ্যোগের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বিচারপতি সিনহা বলেন, “ভারত সফরকালে (প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগে) আমি ভারতের প্রধান বিচারপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশের বিচারকদের প্রশিক্ষণের অনুরোধ করেছিলাম। ভারত সরকার এতে সাড়া দিয়েছে।”

অনুষ্ঠানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের জন্য ২০ তলা আবাসিক ভবন উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা। ২০১১ সালের ১৪ মে এই ভবনের ভিত্তিস্থাপন করেছিলেন তিনি।  

দেড় একর জায়গায় ১৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭৬টি ফ্লাটের এই ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এই ভবনে জিমনেশিয়াম এবং মিলনায়তনও রয়েছে।

অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছলে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ও অ্যাটর্নি জেনালের মাহবুবে আলম।

চার ধর্মগ্রন্থ পাঠের মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। মন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আনিসুল হকও বক্তব্য রাখেন।

প্রধানমন্ত্রী বোতাম চেপে পর্দা সরিয়ে উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করেন। উদ্বোধনের পর মোনাজাত করে তিনি ভবনের বিভিন্ন তলা ঘুরে দেখেন।