দ্বৈত অবস্থানের কারণে ‘ব্যর্থ’ বিরোধী দল: টিআইবি

একদিকে বিরোধী দলের ভূমিকা, অন্যদিকে সরকারের অংশ- এমন ‘দ্বৈত অবস্থানের’ কারণে সংসদের ভেতরে-বাইরে জাতীয় পার্টি ব্যর্থ হচ্ছে বলে মনে করছে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 April 2017, 11:32 AM
Updated : 9 April 2017, 12:07 PM

এ অবস্থানের কারণে দলটির ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বলে মনে করছে সংস্থাটি।

সংসদের সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ অধিবেশনের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে টিআইবির ‘পার্লামেন্টওয়াচ’ প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে এ পর্যবেক্ষণ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দশম সংসদের এই সাত অধিবেশনে সংসদ সদস্যদের উপস্থিতি বেড়েছে, কমেছে কোরাম সঙ্কট। কিন্তু তারপরও কোরাম সঙ্কটের কারণে ৪৭ কোটি টাকার বেশি অপচয় হয়েছে।

রোববার টিআইবির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এই প্রতিবেদনের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়। 

সংবাদ সম্মেলনে প্রোগ্রাম ম্যানেজার জুলিয়েট রোজেটি ও অ্যাসিসটেন্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার অমিত সরকার প্রতিবেদনের সার-সংক্ষেপ উপস্থাপন করেন।

বিরোধী
দলের
ভূমিকা
অসংসদীয়
ভাষা

টিআইবি মনে করে, দশম সংসদের প্রায় তিন বছরের বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রধান বিরোধী দলের ‘বিতর্কিত অবস্থানের কারণে’ তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।

বিএনপির বর্জনের মধ্যে দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিরোধী দলের চেয়ারে বসার পাশাপাশি মন্ত্রিত্বও নিয়েছে জাতীয় পার্টি। তখন থেকে বিএনপি নেতারা জাতীয় পার্টিকে ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ বলে আসছেন।

একদিকে জাতীয় পার্টির জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ আছেন সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার দায়িত্বে। অন্যদিকে সরকারের মন্ত্রিসভায় রয়েছেন তাদের তিন নেতা। এছাড়া দলটির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ আছেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্বে।

সংসদীয় কার্যক্রমে সরকার দলীয় সদস্যদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বিরোধী দলের সদস্যদের সংসদের বাইরের রাজনৈতিক জোটকে নিয়ে অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার উল্লেখযোগ্য বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

এতে বলা হয়, কার্যপ্রণালী বিধি ২৭০ এর ৬ উপবিধি লঙ্ঘন করে সরকার ও বিরোধী দলীয় সদস্যরা অসংসদীয় আচরণ ও ভাষা ব্যবহার করেছেন। বিভিন্ন আলোচনা পর্বে সদস্যরা অসংসদীয় ভাষার ব্যবহারে মোট সময়ের ১৫ শতাংশ ব্যয় করেন।

সরকারি ও বিরোধী উভয় দলের নেতা এবং সদস্যরা সংসদের বাইরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিয়ে বিভিন্নভাবে কটাক্ষ করলেও স্পিকার অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের আলোচনার সময় নিরব ভূমিকা পালন করেছেন বলে জানিয়েছে টিআইবি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অষ্টম ও নবম সংসদে বিরোধী দল সংসদ বর্জন করলেও দশম সংসদে এখনও এ ধরনের চর্চা দেখা যায়নি।

এছাড়া অন্যান্য সংসদের তুলনায় বিরোধী দলের কম ওয়াকআউট করার মাধ্যমে সংসদীয় কার্যক্রমে তারা যে ইতিবাচকভাবে অবস্থান করছে তা নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ভিন্নতার কারণে দশম সংসদ নির্বাচন এবং পরবর্তীতে সংসদীয় কার্যক্রমে বিভিন্ন সময়ে প্রধান বিরোধী দলসহ অন্যান্য বিরোধী সদস্যদের অবস্থান বিতর্কিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “অধিবেশনগুলোতে সংসদ সদস্যদের উপস্থিতি বেড়েছে, কোরাম সঙ্কট আগের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কমেছে। বিরোধী দলের দ্বৈত অবস্থানে সংসদ ও সংসদের বাইরে উভয় জায়গায় তারা ব্যর্থ হচ্ছেন।”

বাস্তব অবস্থা ও সংসদে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার দায় বিবেচনায় নিয়ে বিরোধী দলকে এ ভূমিকা থেকে সরে আসার আহবান জানান তিনি।

সংসদ বেশি কার্যকর ও সংসদে জনগণের দৃশ্যমান প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতে বিরোধী দলের স্পষ্ট অবস্থান দরকার বলে মনে করে টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল।

দেশ-বিদেশে স্বাক্ষরিত চুক্তিসমূহের বিস্তারিত সংসদে আলোচনা না হওয়াকে সংসদীয় কার্যক্রমের ব্যত্যয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

কোরাম
সংকটে
অপচয়
অব্যাহত

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ অধিবেশনে মোট ৪৮ ঘণ্টা ২৬ মিনিট কোরাম সঙ্কটের কারণে অপচয় হয়। এটা মোট ব্যয়িত সময়ের (৩৯৪ ঘন্টা ২১ মিনিট) ১২ শতাংশ। সাতটি অধিবেশনে প্রতি কার্যদিবসে গড়ে ২৮ মিনিট কোরাম সংকটের কারণে অপচয় হয়।

এত বলা হয়েছে, সংসদ পরিচালনার ব্যয়ের প্রাক্কলিত হিসাব অনুযায়ী, সংসদ পরিচালনা করতে প্রতি মিনিটে গড়ে এক লাখ ৬২ হাজার ৪৩৪ টাকা খরচ হয়। এ হিসাবে সপ্তম থেকে ত্রয়োদশ অধিবেশনে কোরাম সঙ্কটে ব্যয়িত মোট সময়ের অর্থমূল্য ৪৭ কোটি ২০ লাখ ৩৩ হাজার ২০৪ টাকা।

প্রতি কার্যদিবসের গড় কোরাম সঙ্কটের সময়ের অর্থমূল্য ৪৫ লাখ ৪৮ হাজার ১৫২ টাকা বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।

অষ্টম, নবম ও দশম সংসদের মধ্যে তুলনাচিত্রে টিআইবির পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, অধিবেশন প্রতি গড় কোরাম সঙ্কট ক্রমান্বয়ে কমেছে। অষ্টম সংসদের প্রতি কার্যদিবসের গড় কোরাম সঙ্কট ছিল ৩৯ মিনিট, নবম সংসদে ৩৩ মিনিট, দশম সংসদে তা কমে ২৮ মিনিটে দাঁড়ায়।

প্রতি কার্যদিবসের গড় কোরাম সংকটের মতো অধিবেশন প্রতি গড় কোরাম সংকটও ক্রমান্বয়ে কিছুটা কমেছে। অষ্টম সংসদের প্রতি অধিবেশনের গড় কোরাম সঙ্কট ছিল ৩৩ মিনিট এবং নবম সংসদে ৩০ মিনিট, দশম সংসদে কমে ২৯ মিনিটে দাঁড়ায়।

সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী ৬০ জনের কম সংসদ সদস্য অধিবেশন কক্ষে উপস্থিত থাকলে স্পিকারকে বৈঠক মুলতবি করতে হয়। তবে উপস্থিতি কম থাকার বিষয়ে কোনো সদস্যকে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয়। স্পিকার এরপর পাঁচ মিনিট ঘণ্টা বাজিয়ে কোরাম পূর্ণ করা বা বৈঠক মুলতবি করতে পারেন।

টিআইবি ২০০১ সাল থেকে সংসদীয় কার্যক্রম নিয়ে অষ্টম সংসদের প্রথম অধিবেশন থেকে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। এ প্রতিবেদনটি ‘পার্লামেন্টওয়াচ’ ধারবাহিকের ১৩তম ও দশম সংসদের ওপর তৃতীয় প্রতিবেদন।