একাত্তরে বন্দি ছিলাম: মুসা

ফরিদপুরের মুক্তিযোদ্ধারা মুসা বিন শমসেরের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ তুললেও বিতর্কিত এই ব্যবসায়ীর দাবি, তিনি একাত্তর পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি ছিলেন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 March 2017, 05:41 PM
Updated : 17 Nov 2021, 11:50 AM

মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি এবং এ নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার আগ্রহহীনতা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই দাবি করেন মুসা।

ফরিদপুর থেকে উঠে আসা এই ব্যবসায়ী বিবৃতিতে নিজেকে বঙ্গবন্ধুর ‘ঘনিষ্ঠজন’ এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির ‘প্রবাদ পুরুষ’ হিসেবে তুলে ধরেছেন।

মুসা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিমের বেয়াই। সেই কারণে তদন্ত সংস্থা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তদন্তে আগ্রহী নয় বলে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ।

এই মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজন মুসাকে একাত্তরে পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে দেখার কথা জানিয়েছেন। সাংবাদিক-কলামনিস্ট আবু সাঈদ তার লেখা বইয়েও মুসার একাত্তরের ভূমিকার কথা তুলে ধরেন।

প্রতিবেদন প্রকাশের সময় বক্তব্য নিতে নানা চেষ্টা চালালেও নাগাল পাওয়া যায়নি মুসার; বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে জাঁকজমক চলাফেরার জন্য যাকে ‘প্রিন্স অব বাংলাদেশ’ হিসেবে তুলে ধরা হয়।

প্রতিবেদন প্রকাশের আট দিন পর ড্যাটকোর প্যাডে মুসা স্বাক্ষরিত বিবৃতিটি আসে, যাতে তিনি শুধু একাত্তরে নিজের অবস্থা তুলে ধরে দাবি করেছেন, ঈর্ষান্বিত হয়ে ‘উঠতি আওয়ামী লীগ নেতা ও ছাত্রলীগ নামধারী যুবকরা’ তার চরিত্র হননে নেমেছিলেন তখন।

নিজেকে ওই সময়কার ‘ছাত্রলীগের অত্যন্ত প্রতাপশালী নেতা’ হিসেবে দাবি করে মুসা বলেন, “২২ এপ্রিল থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমি পাকবাহিনীর হাতে বন্দি ছিলাম।”

মুসার জন্ম ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার কাজিকান্দা গ্রামে। তার প্রকৃত নাম এ ডি এম মুসা (আবু দাউদ মোহাম্মদ মুসা)।

মুসার বাবা শমসের মোল্লা পাকিস্তান আমলে চাকরি করতেন পাট বিভাগের মাঠকর্মী হিসেবে পিএলএ পদে। ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামটের ট্রাকস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকায় বাড়ি করেন তার বাবা। সেখানেই বেড়ে ওঠেন মুসা।

জিয়াউর রহমানের আমলে জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসা শুরু করেন মুসা। প্রথমে তার প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল শাহবাজ ইন্টারন্যাশনাল, পরে এর নাম হয় ড্যাটকো।

তবে বিবৃতিতে মুসা দাবি করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের পর আওয়ামী লীগের শাসনামলেই তিনি জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসা শুরু করেন।

“বঙ্গবন্ধুর সরাসরি সহযোগিতায় আমি সৃষ্টি করি জনশক্তি রপ্তানি খাত, আর গড়ে তুলি বাঙ্গালী জাতির জন্য অফুরন্ত সম্পদের ভান্ডার (Remittance), আর এই সম্পদের ভান্ডার ভোগ করবে জাতি অনন্তকাল। তারই ফলশ্রুতিতে আজ সৃষ্টি হয়েছে ২০১৭ সালের নতুন বাংলাদেশ। ইহা সর্বজন বিদিত সত্য, আমিই জনশক্তি রপ্তানি ও অর্থনৈতিক মুক্তির প্রবাদ পুরুষ।”

ঊণসত্তরের ছাত্র ও গণআন্দোলন চলাকালে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা হিসাবে ভূমিকা রাখার পর ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে তার ভূমিকা ‘অবিস্মরণীয়’ ছিল বলে বিবৃতিতে দাবি করেন তিনি।

“এখানে বলে রাখা ভাল, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল গভীর। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার পরিচয় আমার ছোটবেলায় সেই ১৯৫৪ সাল থেকে। ধীরে ধীরে বড় হয়েছি এবং ছাত্রলীগের রাজনীতিতে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়েছি। শুধু কি তাই, ১৯৭২ সালের পর থেকে বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল আরো ঘনিষ্ঠ।”

১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ফরিদপুরে ঢোকার পর তাদের সঙ্গে উর্দু ও ইংরেজিতে পারদর্শী মুসাকে দেখা যাওয়ার কথা মুক্তিযোদ্ধারা বলে আসছেন। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পরদিন তাকে ধরার কথাও বলেছেন এক মুক্তিযোদ্ধা।

মুসা দাবি করেছেন, ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি ফরিদপুর হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।

তিনি বলেন, “২২ এপ্রিল আমি ফরিদপুর শহর ত্যাগ করার সময় শহরের বাহিরে একটি রাস্তায় মোড় ঘোরার সময় হঠাৎ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হাতে বন্দি হই। আমাকে কোনো প্রকার জিজ্ঞাসাবাদ না করেই অন্যায়ভাবে আমার হাত, পা বাঁধা অবস্থায় নিয়ে যায় এবং আটকে রাখে।

“ছাত্রলীগের অত্যন্ত প্রতাপশালী নেতা হিসেবে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করে উক্ত সেনা ক্যাম্পে দীর্ঘ আট মাস আটক রাখে এবং এই সময়ে আমাকে প্রচন্ডভাবে শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করে।”

১৯৯৭ সালে যুক্তরাজ্যে নির্বাচনে লেবার পার্টির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী টনি ব্লেয়ারের নির্বাচনী প্রচারের জন্য ৫ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে আলোচনায় আসেন মুসা।

একটি দৈনিকে সুইস ব্যাংকে মুসা বিন শমসেরের ৫১ হাজার কোটি টাকা থাকার খবর ছাপা হওয়ার পর তার তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশনের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখিও হতে হয় তাকে।

সম্প্রতি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে মুসার চালানো একটি গাড়ি জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ বলেছে, এই ঘটনায়ও তাকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।