পাল্টে গেছে শিববাড়ির জীবন

সিলেটের দক্ষিণ সুরমা এলাকার শিববাড়ির পাঠানপাড়াসহ আশপাশের কয়েকটি এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা গত চারদিনে পাল্টে গেছে নাটকীয়ভাবে।

সুলাইমান নিলয় জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 March 2017, 11:16 AM
Updated : 27 March 2017, 03:19 PM

দুই বাড়ি ঘিরে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের কারণে শিববাড়ি পাঠানপাড়াসহ আশপাশের বন্দরঘাট, চান্দাই, জৈনপুর, কিসোনপুর এলাকার বাসাবাড়ির গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে কয়েকদিন ধরে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও চলছে না ক্লাস।

সেনাবাহিনী যতটুকু এলাকা ঘিরে রেখেছে তার মধ্যে শিববাড়ি বাজার থাকায় নিত্যদিনের কেনাকাটাও করতে পারছেন না এসব এলাকার বাসিন্দারা। বাধ্য হয়ে অনেকেই পরিবার-পরিজনকে পাঠিয়ে দিয়েছেন কাছাকাছি কোনো আত্মীয়ের বাসায়।

গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে একই ব্যক্তির মালিকানাধীন পাঁচ তলা ও চার তলা বাড়ি দুটি জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে ঘিরে ফেলে পুলিশ। শনিবার সকালে শুরু হয় সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নের ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’।

সেদিন ব্যাপক গোলাগুলির মধ্যে বাড়ির ভেতরে আটকে পড়া ৭৮ জনকে উদ্ধার করেন কমান্ডোরা। সোমবার অভিযান চতুর্থ দিনে গড়িয়েছে।

এই অভিযানের মধ্যেই শনিবার সন্ধ্যায় কাছেই এক এলাকায় দুই দফা বিস্ফোরণে দুই পুলিশ সদস্যসহ ছয়জন নিহত হন।

অভিযানের খবর জানতে বন্দরঘাট এলাকার রাস্তায় উৎসুক জনতা

সুনামগঞ্জের সাল্লা থানার দিনমজুরের ছেলে আনু মিয়া লেপ-তোষক তৈরির কাজ করেন। স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন শহরতলীর বন্দরঘাট এলাকায়। মূলত প্রতিদিন শহরের কাজীবাজার কিনব্রিজ এলাকায় কাজের জন্য যেতেন তিনি।

শীতের আগে থেকে শুরু হয় তার কাজের মূল মৌসুম, চলে শীতের শেষ পর্যন্ত। এ সময় বাড়ি বাড়ি গিয়ে লেপ তোষক তৈরি করেন। বছরের অন্য সময়ে বিভিন্ন সামগ্রী বাড়ি বাড়ি বিক্রি করেন। শুক্রবার থেকে সে কাজও বন্ধ, কাজের জন্য শহরে যেতে পারছেন না, শিববাড়িতে বাজার করতে যেতে পারছেন না। বাসায় গ্যাস নেই, বন্ধ রান্নাও। নিরুপায় হয়ে স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিয়েছেন বাপের বাড়ি।

“এখন আর কী করব, অপেক্ষা করছি, যদি অভিযান শেষ হয়, জঙ্গিরা ধরা পড়ে, তাহলে আবার হয়তো কাজে যাব, অন্যথায় হয়তো বাড়ি চলে যাব,” বলেন আনু মিয়া।

অভিযানের খবর জানতে বন্দরঘাট এলাকার রাস্তায় উৎসুক জনতা

বন্দরঘাট এলাকার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব আব্দুল আহাদ শফিক জানালেন, শিববাড়ি বাজার থেকে নিয়মিত বাজার করতেন। কিন্তু বাজার বন্ধ থাকায় বাসার খাবারের নিয়মিত মজুদে টান পড়েছে। রোববার রান্না করা সবজি খিচুড়ি দিয়ে চলেছে সোমবার সকাল পর্যন্ত। আরেকবার হয়ত খিচুড়ি রান্না করা যাবে, এরপর ঘরে আর কোনো খাবার থাকবে না।

শহরের ভেতর দিকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে খালের মুখের বাজার আর আট কিলোমিটার দূরে মোগলা বাজার থাকলেও সেখানে এরই মধ্যে সব জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে বলে জানান তিনি।

আব্দুল আহাদ বলেন, “এলাকার অনেক লোক এসব কারণে আশেপাশের আত্মীয় স্বজনের বাসা চলে গেছে।”

তিনি জানান, বন্দরঘাটের পাশাপাশি শিববাড়ি, পাঠানপাড়া, চান্দাই, জৈনপুর, কিসোনপুর প্রভৃতি এলাকাতে গ্যাস না থাকায় মানুষ লাকড়ি সংগ্রহ করে হয়তো কিছু রান্না করছে।

অভিযানের কারণে কাজে যেতে পারছেন না, তাই কাটছে অলস সময়। সিলেট শহরতলীর বন্দরঘাট এলাকার ছবি

সিলনেট সিকিউরিটিজের কর্মকর্তা মানিক রায় বলেন, অফিসের সব কাজ স্বাভাবিকভাবে চললেও তার জন্য ছুটি, কারণ অভিযান এলাকা পার হয়ে তাকে অফিসে যেতে হয়। অঘোষিত ছুটি তার প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা স্ত্রীরও।

মানিক বলেন, “মূলত সবার সব স্বাভাবিক কাজকর্ম বন্ধ, জনজীবন স্থবির। সাত-আট বছর যাবত এই এলাকায় আছি। এমন পরিস্থিতি চিন্তাও করা যায় না।”

কষ্ট হলেও তিনি চান অভিযান যেন সফলভাবে শেষ হয়।

“আমাদের কষ্ট হলেও আমরা চাই এ অভিযান সফলভাবে সমাপ্ত হোক, মানুষ এরপর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে।”

সিলেট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র শিববাড়ির বন্দরঘাটের সোনারগাঁও আবাসিক এলাকার মোহাম্মদ নয়ন জানালো শনিবার থেকে তার স্কুল বন্ধ, স্কুলে এবার স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানও হয়নি। অভিযান এলাকা পেরিয়ে পাশের এলাকায় থাকেন তার প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষসহ অনেক শিক্ষক। অভিযানের কারণে তারা না আসায় ক্লাস চলছে না।

নয়নের ভাষ্য, “আগামী সপ্তাহে আমাদের পরীক্ষা হবার কথা ছিল, কিছু বিষয়ে আগে পড়ানো হয়নি এমন অধ্যায় পড়ানো হবে বলে শিক্ষকরা জানিয়েছিলেন, পড়া হচ্ছে না। পরীক্ষা হবে কিনা সেটাও নিশ্চিত নয়।”