লাইসেন্স পেতে শিক্ষার শর্ত, ফোন কানে গাড়ি চালালে শাস্তি আসছে

ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে ন্যূনতম অষ্টম শ্রেণি পাসের বাধ্যবাধকতা এবং গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে শাস্তির বিধান রেখে নতুন আইন করছে সরকার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 March 2017, 08:00 AM
Updated : 27 March 2017, 12:22 PM

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘সড়ক পরিবহন আইন- ২০১৭’ এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়।

সভা শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সামরিক শাসনামলে করা ‘দ্য মোটর ভেহিকেল অর্ডিনেন্স ১৯৮৩’ এর বদলে এই নতুন আইন করা হচ্ছে। এই এখানে বেশ কিছু বড় পরিবর্তন আনা হচ্ছে।

“পরিবহন সেক্টরটা অনেক ভাইব্রেন্ট, এখানে অনেকগুলো এজেন্সি কাজ করে এবং জাতীয়-আন্তর্জাতিকভাবে অনেক লিংক রাখতে হয়। এজন্য যথেষ্ট ওভারহলিং করে নতুন আইন করা হয়েছে। শাস্তি বাড়ানো হয়েছে এবং কিছু নতুন বিধান যুক্ত করা হয়েছে। সময়ের ধারাবাহিকতায় যে পরিবর্তনগুলো হয়েছে সেগুলো নিয়ে আসা হয়েছে।”

>> আগের আইনে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো শর্ত ছিল না। নতুন আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার জন্য চালককে কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণি পাস হতে হবে।

>> চালকের সহকারী হতে হলেও বাধ্যতামূলকভাবে লাইসেন্স নিতে হবে। এজন্য অন্তত পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া থাকতে হবে। আগের অধ্যাদেশে সহকারীদের লাইসেন্সের কথা থাকলেও তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত ছিল না।

>> গাড়ি চালনার জন্য চালকের বয়স আগের মতই কমপক্ষে ১৮ বছর হতে হবে। আর পেশাদার চালকদের বয়স হতে হবে কমপক্ষে ২১ বছর।

>> নতুন আইনের খসড়ায় ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে অনধিক ৬ মাসের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড দেওয়া হবে। আগের আইনে এই ধরনের অপরাধের জন্য তিন মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান ছিল।

>> চালকের সহকারীর লাইসেন্স না থাকলে এক মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখার কথা বলা হয়েছে নতুন আইনের খসড়ায়।

>> নতুন আইন পাস হলে কেউ গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না।এ আইন ভাঙলে এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে।

>> ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে- এমন অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় চালকদের গ্রেপ্তার করতে পারবে। অর্থাৎ, ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালেও তাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা যাবে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, চালকরা যাতে আইন মেনে চলেন, সেজন্য প্রস্তাবিত আইনে পয়েন্টভিত্তিক ব্যবস্থা চালুর কথা বলা হয়েছে।

“পৃথিবীর অন্যান্য দেশে (চালকদের) পয়েন্ট কাটার সিস্টেম আছে। অর্থাৎ ড্রাইভার যদি একবার দোষ করেন, তাহলে একটা বা দুইটা পয়েন্ট কাটতে থাকে। এভাবে পয়েন্ট শূন্য হয়ে গেলে ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল হয়ে যায়।

“আমাদের দেশেও সে প্রস্তাবটি রাখা হয়েছে। ড্রাইভিং সংক্রান্ত বিধিবিধান যদি কেউ অমান্য করে তাহলে তার পয়েন্ট কর্তন হতে থাকবে। মোট ১২ পয়েন্ট বরাদ্দ থাকবে। কোন অফেন্সে কত পয়েন্ট কাটা যাবে সেটা তফসিলে বলা আছে। পয়েন্ট শূন্য হয়ে গেলে আর ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকবে না।”

পয়েন্ট কাটা শেষে কারও লাইসেন্স বাতিল হয়ে গেলে সে নতুন করে আবার লাইসেন্স করতে পারবে কি না- তা নিয়ে ‘সন্দেহ আছে’ মন্তব্য করে শফিউল আলম বলেন, “তাকে অযোগ্য ঘোষণা করবে।”

কী কী কারণে চালকদের পয়েন্ট কাটা যাবে, তার উদাহরণ দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, “যেমন মোটরযানের গতিসীমা না মানলে এক পয়েন্ট কাটা যাবে।”

ড্রাইভিং সনদ পেতে চালক ও তার সহকারীদের শিক্ষাগত সদনের বাধ্যবাধকতার বিষয় শফিউল আলম বলেন, “চালককে অষ্টম শ্রেণি পাস হতে হবে এই শর্ত যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। আগে লেখপড়ার এই সিলিংটা ছিল না। চালকের সহকারীকে কমপক্ষে লিখিবার ও পড়িবার সক্ষমতা থাকিতে হইবে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত তার লেখাপড়া থাকতে হবে।”

অপরাধ ও দণ্ড মূল আইন থেকে বের করে খসড়ায় তফসিল আকারে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, আগের অধ্যাদেশে জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যবহারের জন্য দুই বছরের কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান থাকলেও প্রস্তাবিত আইনে জেল দুই বছর রেখে জরিমানা তিন লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

ফিটনেস চলে যাওয়ার পরেও মোটরযান ব্যবহার করলে এক বছরের জেল বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানার প্রস্তাব রয়েছে খসড়ায়। এই অপরাধে আগের আইনে ছয় মাসের জেল বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা হত। এই শাস্তি হবে মোটরযানের মালিকের।

এছাড়া দুর্ঘটনার জন্য দণ্ডবিধি অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হবে জানিয়ে শফিউল বলেন, দণ্ডবিধিতে তিন রকমের বিধান আছে। নরহত্যা হলে ৩০২ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের সাজা হবে। খুন না হলে ৩০৪ ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে মৃত্যু ঘটালে ৩০৪ (বি) ধারা অনুযায়ী তিন বছরের কারাদণ্ড হবে।

বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে কাউকে নিহত বা আহত করলে দণ্ডবিধি অনুযায়ী সাজা হবে। দুই গাড়ি পাল্লা দিয়ে দুর্ঘটনা ঘটালে তিন বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে।

দুর্ঘটনায় না পড়লেও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর জন্য আইনে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা দুই লাখ টাকা জরিমানার প্রস্তাব করা হয়েছে।

ওজনসীমা অতিক্রমের ক্ষেত্রে (যেমন পাঁচ টন ধারণক্ষমতার ট্রাকে এর বেশি ওজন পরিবহন করলে) গাড়ির মালিক ও চালকের তিন বছরের কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা জরিমানার প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়ায়।

‘মোটরযান চলাচলে সাধারণ নির্দেশাবলী’ নামে একটি নতুন ধারায় ২৫টি নির্দেশনা যুক্ত করা হয়েছে জানিয়ে শফিউল আলম বলেন, গাড়ি চালানোর সময় চালক মোবাইল ফোন বা ওই ধরনের কোনো সরঞ্জম ব্যবহার করতে পারবেন না।

সিট বেল্ট না বেঁধে গাড়ি চালালে; মহিলা, শিশু, প্রতিবন্ধী ও বয়জ্যেষ্ঠ যাত্রীর জন্য সংরক্ষিত আসনে অন্য কোনো যাত্রী বসলে এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে।

মদ পান করে বা নেশাজতীয় দ্রব্য সেবন করে গাড়ি চালালে, সহকারীকে দিয়ে গাড়ি চালালে, উল্টো দিকে গাড়ি চালালে, নির্ধারিত স্থান ছাড়া অন্য স্থানে গাড়ি থামিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে, চালক মোটরসাইকেলে একজনের বেশি সহযাত্রী ওঠালে, মোটর সাইকেলের চালক বা সহযাত্রীর হেলমেট না থাকলে, গাড়ির ছাদে যাত্রী বা পণ্য বহন করলে, গাড়ি সারানোর নামে সড়ক বা ফুটপাতে যানবাহন রেখে পথচারীদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করলে, ফুটপাতের ওপর দিয়ে কোনো মোটরযান চলাচল করলে সর্বোচ্চ তিন মাস কারাদণ্ড বা ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড প্রস্তাব করা হয়েছে বলেও জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।