তেইশ বছরের শোষণ থেকে বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের শ্বাসরোধ করতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এ দেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ‘অপারেশন সার্চলাইট’নামের সেই অভিযানে কালরাতের প্রথম প্রহরে ঢাকায় চালানো হয় গণহত্যা।
২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী ইপিআরের বেতারে তার এই ঘোষণা প্রচারিত হয়।
অবশ্য তার আগেই ৭ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক জনসভায় বাঙালির অবিসংবাদিত এই নেতা বলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
তিনি বাঙালি জাতিকে শত্রুর মোকাবিলা করার আহ্বান জানান। কার্যত সেটাই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা, যার পথ ধরে কালরাতের পর শুরু হয় বাঙালির প্রতিরোধ পর্ব।
নয় মাসের যুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান, আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং জাতির অসামান্য ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে নিহতদের স্মরণে এবারই প্রথম দিনটিকে জাতীয়ভাবে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করল বাংলাদেশ। রোববার স্বাধীনতা দিবসে বাঙালি জাতি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের।
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সাধারণ ছুটির দিনে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা আয়োজনে পালিত হবে গৌরবের দিনটি।
রাষ্ট্রপতি ও সরকার প্রধানের পর সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে স্মৃতিসৌধ।
স্মৃতিসৌধের আনুষ্ঠানিকতার পর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে শিশু-কিশোর সমাবেশে অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করবেন তিনি।
মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে আরও বেগবান করতে দেশে ও বিদেশে সব বাংলাদেশি নাগরিককে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক-সমর্থকসহ সব স্তরের জনগণসহ মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের স্মরণ করে আবদুল হামিদ বলেছেন,বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে তাদের অবদান চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
“স্বাধীনতার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে। এজন্য প্রয়োজন দলমত নির্বিশেষে সকলের আন্তরিক ও ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস।”
রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেছেন,বাংলাদেশের জনগণ সব সময় গণতন্ত্র,শান্তি ও উন্নয়নকামী। তারা জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদসহ কোনো ধরনের সহিংসতা সমর্থন করে না।
“আমাদের মনে রাখতে হবে,উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্রের বিকাশ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ খুবই জরুরি। এ জন্য জাতীয় জীবনে আমাদের আরও ধৈর্য,সংযম ও সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে।”
প্রধানমন্ত্রীর তার বাণীতে দেশবাসী ও প্রবাসী বাঙালিদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছেন,“২৬ শে মার্চ আমাদের জাতির আত্মপরিচয় অর্জনের দিন। পরাধীনতার শিকল ভাঙার দিন।”
স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এবং উন্নয়ন ও গণতন্ত্রবিরোধীদের যে কোনো অপতৎপরতা ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন শেখ হাসিনা।
বাণীতে তিনি বলেন, “আসুন সকল ভেদাভেদ ভুলে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের উন্নয়ন ও গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাই।
“সবাই মিলে একটি অসাম্প্রদায়িক, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি।”
দিবসটি উপলক্ষে এক বিবৃতিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অভিযোগ করেন, বাংলাদেশকে ‘তাঁবেদার’ রাষ্ট্র বানানোর জন্য ‘দেশবিরোধী নানা অসম চুক্তির মহড়া’ চলছে।
তিনি বলেন, “লাখো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করার তৎপরতায় লিপ্ত দেশি-বিদেশি চিহ্নিত মহল। এখন নানা অসম চুক্তির মহড়া চলছে।
“এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। সকল ষড়যন্ত্র চক্রান্ত প্রতিহত করে মাতৃভূমির স্বাধীনতা সুরক্ষা এবং গণতন্ত্রের পতাকাকে সমুন্নত রাখতে আমাদের সকলকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। গড়ে তুলতে হবে সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্য। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে আজ দেশবাসীর প্রতি আমি এ আহ্বান জানাই।”
দিনের কর্মসূচি
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপগুলো ইতোমধ্যে সাজানো হয়েছে জাতীয় পতাকা ও অন্যান্য পতাকায়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় আগের রাতেই আলোকসজ্জা করা হয়েছে।
রোববার সকালে সব সরকারি, আধা সরকারি,স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে উত্তোলন করা হবে জাতীয় পতাকা।
দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে এদিন সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র বের করবে, প্রকাশ করবে বিশেষ নিবন্ধ, সাহিত্য সাময়িকী। বিটিভি, বাংলাদেশ বেতার, বেসরকারি বেতার/টিভি চ্যানেলগুলো প্রচার করবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা।
দেশের সব শিশু পার্ক, চিড়িয়াখানা, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এদিন সবার জন্য উন্মুক্ত ধাকবে। সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হবে দেশের শান্তি ও অগ্রগতি কামনায় বিশেষ দোয়া ও উপাসনার আয়োজন।
মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্র, হাসপাতাল, জেলখানা, সরকারি শিশুসদনসহ অনুরূপ প্রতিষ্ঠানে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে।
জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসেও দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।