এইচ এম এরশাদ আমলে নির্মাণের সময় টাওয়ারের নকশাকার সৈয়দ মইনুল হোসেনকে না জানিয়ে তার নকশায় পরিবর্তন আনা হয় বলেও অভিযোগ করেন গণপূর্ত সাভার সার্কেলের তখনকার উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মাহবুব-উল আলম।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুরকৌশলে স্নাতক মাহবুব ১৯৭৭ সালে গণপূর্ত অধিদপ্তরে যোগ দেন। ২০০৮ সালে অবসর নেওয়ার পর এখন কাজ করছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে।
স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে একান্ত আলাপে মাহবুব খুলে বলেন স্মৃতিসৌধের নির্মাণকাজের তৃতীয় ধাপের কথা- সামরিক শাসনামলের ওই সময়ে তাকেই দেখতে হচ্ছিল মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্থাপত্যটির সব খুঁটিনাটি।
মাহবুব-উল-আলম:: আমি তখন উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী, মানে সাব ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার। অনেক আগে তো। মার্শল ল’র সময়...
একচুয়ালি এটার নাম স্মৃতিসৌধ ছিল না, ছিল ‘অজ্ঞাতনামা শহীদদের স্মৃতিসৌধ’। ন্যাশনাল মোসেলিয়াম (mausoleum) ফর আননোন মার্টায়ার্স। পুরনো ফাইলে এখনও ওই নাম পাওয়া যাবে। ৭২ সালে যখন প্রথম প্রকল্প নেওয়া হয় শেখ সাহেবের সময়ে, ওই সময়কার নাম এটা। বিভিন্ন জায়গার শহীদ হওয়া মানুষদের দেহবাশেষ বাক্সে করে নিয়ে ওই জায়গায় রাখা ছিল, গণকবর...।
ফেইজ ওয়াইজ কাজ হচ্ছিল। এরশাদ ক্ষমতা নেওয়ার সময় এটা এখনকার মতো হয়...। তখন এর নকশার জন্য ন্যাশনাল লেভেলে কমপিটিশন কল করা হলো; সেখানে ও (সৈয়দ মইনুল হোসেন) ফার্স্ট হইলো।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: প্রথমবার যখন চাওয়া হলো তখন বোধহয় কোনো নকশা জমা পড়েনি...
মাহবুব-উল-আলম:: মে বি। তখন আমরা... উই আর নট সিরিয়াস...। এটা পসিবল (নকশা জমা না পড়া)। এর কাজটাতো স্থাপত্য অধিদপ্তর করেছিল। একসেপ্ট দিস টাওয়ার। বাকি কমপ্লেক্স ওদের (স্থাপত্য অধিদপ্তর)। শুধু টাওয়ারের ডিজাইনের জন্য কম্পিটিশন কল করা হয়েছিল।
মাহবুব-উল-আলম::এটা তখন সাভার সার্কেলে ছিল। সার্কেলের আন্ডারে একটা সাব-ডিভিশনের ইঞ্জিনিয়ার ছিলাম আমি। উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী। পুরো কাজটা আমার সাব ডিভিশনের আওতায় ছিল। এখানে ইলেট্রিকাল, স্থাপত্য অনেক লোক জড়িত ছিল। সিভিলের কাজটা ছিল আমার উপবিভাগের আওতায়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম:আপনি তাহলে নির্মাণ প্রকৌশলী ছিলেন...
মাহবুব-উল-আলম:: (কিছুক্ষণ চুপ থেকে) এই টার্মটা বলা বোধহয় ঠিক হবে না। আমি সিভিলের সব কাজ করেছি। পুরো সময়টা..লে-আউট দেওয়া, মাটি কাটার সমস্ত কাজ। তবে সরকারি কাজ তো। খুব অল্প সময়ে ইট হ্যাজ বিন ডান। লেস দ্যান সিক্স মান্থ।
এটা একটা গল্পের মতো। আই ওয়াজ দেয়ার। একদিন হঠাৎ করে খবর পেলাম এরশাদ যাবেন। আমরা সবাই গেলাম ওখানে। যাওয়ার পরে এরশাদ সাহেব ঘুরে দেখলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আগামী ১৬-ই ডিসেম্বরের আগে এটা উদ্বোধন করা যাবে না?’ কে যেন ভিড়ের মধ্যে... সামবডি সেইড, ‘করা যাবে স্যার।’ এরশাদ বলে উঠলো, ‘লেটস ডু ইট।’
কেউ যে আপত্তি করবে বা বলবে এটা সম্ভব না… সেটা কেউ বলতে পারল না। পরে চিফ ইঞ্জিনিয়ার, চিফ আর্কিটেক্ট, সচিব সব নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে চলে গেল। পরের দিন থেকে কাজ শুরু হলো। মার্শাল ল’ না, করতে তো হবেই। টেন্ডার কল করা হল। কনকর্ড ওয়াজ দ্য লোয়েস্ট বিডার।
মাহবুব-উল-আলম: সেটা অনেক আগে। ৭২ সালে। ছোট একটা বেদি ছিল। আমি দেখেছি। খুব স্মল স্কেলে ছিল। ওখানেও বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানরা শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। তবে তখন এমন টাওয়ার ছিলে না। ওই বেদিটা কিন্তু প্রোপারলি অনারড ছিল। যতদূর মনে পড়ে ওই পাথরটা আমাদের অফিসে ছিলে। পরে মনে হয় নতুন নির্মিত টাওয়ারের উদ্বোধন ফলকে লাগানো হয়েছিল।
এরশাদও একটা ভিত্তিপ্রস্তর করেছিল, সেটা কেউ না কেউ ভেঙে দিয়েছিল। অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমাদের। মার্শাল ল’। একদিন ভোর বেলা গিয়ে দেখলাম ওটা ভাঙা। কে বা কারা ভেঙে ফেলেছিল।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম:স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্সে একটা শিখা চিরন্তনের মতো কিছু করার পরিকল্পনা ছিলো বলে শুনেছিলাম...
মাহবুব-উল-আলম: ওটা করেছিলাম। শিখা অনির্বাণ ইজ স্টিল দেয়ার (নকশায়)। যেখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়, ওটা একটু কবরের মতো। হেক্সাগোনাল...। জেনারেল আব্দুর রহমান [মেজর জেনারেল আবদুর রহমান] এটা বন্ধ করে দিয়েছিল।
মাহবুব-উল-আলম:: হুমম। একদিন ওইখানে (সাভারে) গিয়েছিল। আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘এটা কী?’ আমি বললাম, এখানে একটি শিখা অনির্বাণ টাইপের হবে। তিনি বললেন, ‘পূজা করবে না কি? বোম মেরে উড়িয়ে দিব। টেল ইউর জেনারেল। কিচ্ছু হবে না এখানে।’
ওখানে লাল ইটের একটা মসজিদ আছে। ওটা দেখিয়ে বললো, ‘এখানে মাইক দিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত আজান দিবেন।’
নিচে গ্যাসের লাইন করা ছিল। ব্রোঞ্জ মেটালের তৈরি একটা বার্নারও করা হয়েছিল। ওটা আর বসানো হয় নাই। সাইট অফিসে ছিল। আব্দুর রহমান বন্ধ করে দিয়েছিল। ওই সময় কোথাও এমন শিখা ছিল না। এটা এরশাদ সাহেবেরও কানে গিয়েছিল… পরে আর কেউ উচ্চবাচ্য করে নাই।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: স্মৃতিসৌধ নির্মাণের সময় আপনাদের কাজের চাপ কেমন ছিলো?
ওইখানে একটা ছোটখাটো গ্রামের মতো হয়ে গেছিল। আমি ওখানেও অফিস করতাম, ঢাকায়ও অফিস করতাম। ... আমাদের সাভার ক্যান্টনমেন্টে প্রায়ই ডাকা হতো। মেজর-ক্যাপ্টেনরা কত কী যে করছে...। এমন অবস্থা হয়েছিল তখন যে চোখ বন্ধ করে দিলেও গাড়ি চালিয়ে চলে যেতে পারতাম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম:স্থপতি মইনুল হোসেনের সঙ্গে আপনার কি কাজের সূত্রে পরিচয়?
মাহবুব-উল-আলম:: হ্যাঁ। কাজের পরে আর দেখাই হয় নাই। আমাদের অফিসে আসে নাই। খুব ইন্ট্রোভার্ট ছিল। মইনুলকে আমরা ইউনির্ভার্সিটি থাকা অবস্থায় দেখি নাই। খুব শাই টাইপের ছিল।
মাহবুব-উল-আলম:: এটা অস্বাভাবিক কিছু না। সমস্ত দিন আমরা কাজ করলাম। পরে আর্মি টেক ওভার করল, আমাদের দূরে সরিয়ে দিল।
স্মৃতিসৌধের প্লেট তো সাতটা। মইনুলের নকশায় আটটা না নয়টা যেন ছিল। এগুলি পরে কমানো হয়েছে। স্ট্রাকচারাল নেসিসিটির জায়গা থেকে। বড় বড় পাঞ্চ আছে। ইউ ক্যান ওয়াক থ্রু। নিচের বেইজমেন্ট করা হয়েছিল ফর মিউজিয়াম। পাঞ্চগুলো করা হয়েছিলো টু রিডিউস দ্য ওয়েট। অনেক মোটা, প্রায় আড়াই ফিট। মাঝখান থেকে ড্রপ করা হল।
মইনুলকে জিজ্ঞাসাও করে নাই। ওর কাছ থেকে শুধু ডিজাইনটা নিয়েছিল। দ্যাটস অল। আর কিছুই জিজ্ঞাসা করা হয় নাই। এতবড় একটা কর্মকাণ্ড, ওকে এক কাপ চা খাইতেও ডাকে নাই। ওর মন খারাপের কারণ তো এটা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম:সাতটা স্তম্ভের তো ব্যাখ্যাও আছে। ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে ‘৭১ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায় বোঝানো হয়েছে...
মাহবুব-উল-আলম:: এগুলি পরে বানানো হয়েছে। একেকজন একেক রকম করে...। যখন সাতটা স্তম্ভ হয়ে গেল। তখন বলা হল, এর একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাও। স্মৃতিসৌধ যে একটা করা হল, সেটার ব্যাখ্যা দিতে হবে।
এই যে টাওয়ারটা, এটাও কিন্তু সাপোজ টু কাভারড বাই রেড ব্রিকস। সেটা কিন্তু হয় নাই। পরে সেই আইডিয়া ড্রপ করা হয়।
মাহবুব-উল-আলম:: উদ্বোধনের সময় এগুলি বলে নাই। আরও পরে, যখন ভিজিটররা আসে। আর্মির লোকজন, মন্ত্রণালয়ের লোকজন তাদের নিয়ে যায়... তখনতো এক্সপ্লেইন করতে হবে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ১৯৮৩ সালের নভেম্বরে ঢাকা সফরের সময় স্মৃতিসৌধে গাছ লাগিয়েছিলেন, ওটা নিয়ে নাকি কী একটা ঘটনা আছে...
মাহবুব-উল-আলম:: রানি এলিজাবেথ যে ভিজিটরস বুকে সই করে, সেই কলমটা আমিই কিনছিলাম। উনি আমহার্সিয়া নোবলিস গাছের চারা লাগিয়েছিলেন। গাছটা এখনও রেয়ার। তখন গাছটা ছোট, ফুলটুল নাই। লাগানোর আট-নয় দিন পর খবর পাইলাম গরু বা ছাগলে খেয়ে ফেলেছে। অরক্ষিত তো তখন। কী বিপদ! এখন হইলে তো ছবি-টবি বের হয়ে... তখন ওইরকম আরেকটা লাগানো হল।
মাহবুব-উল-আলম:: এই কাজের ভিত্তিপ্রস্তর বঙ্গবন্ধু স্থাপন করে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ’৭৩ সালের ডিসেম্বর থেকে জুন ৭৪ পর্যন্ত প্রথম ফেইজ। দ্বিতীয় ফেইজ ছিল জানুয়ারি ’৭৫ থেকে জুন ’৮২। আর তৃতীয় পর্যায় ছিল অগাস্ট ’৮২ থেকে জুন ’৮৪ পর্যন্ত।
জিয়াউর রহমানের সময় মানে আফটার ১৫ অগাস্ট, খুব স্লো স্পেসে কাজ হয়েছিল। হয়ত একটা বাগান করল, একটা দেয়াল তুলল- এই ধরনের কাজ হয়েছে। দৃশ্যমান তেমন কিছু হয় নাই। টাওয়ারটা মূল পরিকল্পনাতেই ছিল। এটা যে এরশাদের করা টাওয়ার, তাও নয়। সে এক্সিকিউট করছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন...
মাহবুব-উল-আলম:: ’৮২ সালের ১৬ ডিসেম্বর নতুন বেদিতে ফুল দিয়ে এটার উদ্বোধন করা হয়। আর্মিরা করল, বিউগল বাজিয়ে। কাজটা কিন্তু তখনও ইনকমপ্লিট। টাওয়ারও ওয়াজ নট কমপ্লিটেড দ্যাট টাইম।
আর এই যে ভিজিটরস বুক। প্রথম যে বানিয়েছিলাম। কী যে অবস্থা! জিন্দাবাহারে বসে...। ভেলভেটে মোড়ানো। রানি আসলো... বিদেশি কলমতো আর এত পাওয়া যেত না।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: আপনাকে ধন্যবাদ, এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য।
মাহবুব-উল-আলম:: আপনাকেও ধন্যবাদ।