তাদের চোখে ২৫ মার্চের সেই কালরাত

একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ও ইকবাল হলে (শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) হত্যাযজ্ঞ চালানোর মধ্যে গণহত্যা শুরু করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 March 2017, 03:40 PM
Updated : 25 March 2017, 03:40 PM

শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারীদের উপর সেদিনের সেই ভয়াবহ নারকীয় নির্যাতনের চিত্র উঠেছে জগন্নাথ হলের প্রত্যক্ষদর্শীদের স্মৃতিচারণে।

সেই পাক সেনাদের নারকীয হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন হলের সাবেক কর্মচারী রবীন্দ্র মোহন দাশ।তখন তার বয়স ছিল ১৪ বছর, পড়তেন পল্টন লাইন স্কুলে।তার বাবা ওই হলের কর্মরত ছিলেন।

২৫ মার্চ রাতের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ায় জন্য আমাকে টোকেন দেওয়া কথা ছিল। কিন্তু পরে বলে যে, কালকে দেওয়া হবে।এটা গোপন বিষয়।”

“এদিন রাত সাড়ে ১১টার পরে শিলা বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে হলে ঢোকে পাকসেনারা।শাই শাই, ঠাস ঠাস শব্দ।গুলি ঘরের টিন ভেদ করে ভেতরে ঢুকতেছে।তখন আমার বড়ভাই সবাইকে খাটের নিচে ঢুকতে বললে আমরা খাটের নিচে বসে থাকি।

“এমন সময় আমাদের ঘরের পাশে একজনকে পাক সেনারা জোরে জোরে পেটাচ্ছে, সে আমার বড় ভাইয়ে নাম ধরে ডাকে (ফণিদা)।পরে তারা (পাকসেনা) আমাদের ঘরের দরজা ভেঙে ভেতর ঢুকে বড় ভাইকে মারধর করে।”

বড় ভাই জিজ্ঞাসাবাদের জবাবে নিজেকে হলের ‘সুইপার’ পরিচয় দিলেও তাকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায় জানিয়ে রবীন্দ্র মোহন বলেন, “ঘণ্টাখানেক পর ছেড়ে দিলে সে ঘরের মধ্যে এলে দেখি তার বুক থেকে রক্ত পড়ছে।পরে কাপড় দিয়ে বেঁধে দেই।এর কিছুক্ষণ পর পাক সেনারা ঘরগুলোয় আগুন দিলে তা খুব দ্রুত পুড়ে যায়।

“১২টার দিকে একটি কামান দিয়ে উত্তর বাড়ির সামনে শহীদ মিনারে হামলা চালিয়ে ভেঙে ফেলে। সেই বারুদের আগুনে উত্তর গেটের দুইজন দারোয়ান ঝলসে গিয়ে মারা যায়।”

পাক সেনারা হলের প্রতিটি ভবনের টয়লেট ও পানির ট্যাংকসহ সব কক্ষে তল্লাশি চালিয়ে ছাত্রদের খুঁজে বের করে হত্যা করে বলে জানান রবীন্দ্র মোহন।

“পরে আযানের আগে আগে পাক সেনারা আবার স্টাফ কোয়ার্টারে এসে বেছে বেছে আমাকেসহ তাগড়া তাগড়া ৩১ ছেলেকে একটি গোয়াল ঘরের মধ্যে আটকে রাখে।পরে এর মধ্যে ১৫ জনকে নিয়ে যায় ছাত্র-শিক্ষকদের লাশ আনতে।দেব স্যার (গোবিন্দ চন্দ্র দেব), মধুদার লাশও ওখানে নিয়ে আসা হয়।তাদের দিয়ে লাশ এনে বর্তমানের গণকবরের ওখানে রাখে। ভোরে লাশ আনা শেষ হলে তাদের (লাশ বহনকারী) এক জায়গায় গোল করে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে।

“পরে আমাদের ১৬ জনকে নিতে আসে।কিন্তু হঠাৎ এক পাকসেনা আমাকে বেধড়ক মারতে থাকলে আমি একটি গর্তের মধ্যে পড়ে যাই।তখন আমাকে বাদ রেখেই ওই ১৫ জনকে নিয়ে গিয়ে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে।”

পরে রবীন্দ্র মোহন ও তার পরিবারের সদস্যরা প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে গিয়ে আশ্রয় নেন।

“এরপর পাক সেনারা সকাল সাড়ে ৭টার দিকে চলে গেলে মাঠের দিকে যাই।সেখানে লাশের স্তুপে একজনকে হাত নেড়ে ইশারা করতে দেখি।তার কাছে গেলে উনি আমার কাছে পানি খেতে চান।হলের পুকুর থেকে হাতের মুঠোতে করে পানি আনার চেষ্টা করলেও তা পড়ে যায়।পরে একটি কৌটায় পানি নিয়ে যাই, কিন্তু পানি তার মুখে দিতেই তিনি মারা যান।”

সেদিন ওই মাঠে প্রায় আড়াইশ’ জনের লাশ পড়ে থাকতে দেখেন রবীন্দ্র মোহন।এছাড়া হল থেকে বের হয়ে সদরঘাটের দিকে পালানোর সময়ও রাস্তার দুপাশে শুধু লাশ আর লাশ পড়ে থাকতে দেখেন তিনি।

ওইদিন হত্যা করা হয় বকুল রাণী দাশের স্বামী সুশীল চন্দ্র দাশকে।সুশীল ছিলেন জগন্নাথ হলের প্রহরী।২২-২৩ বছরের বকুলের কোলে তখন তিন মাসের সন্তান দীলিপ দাশ।

বকুল বলেন, “সাড়ে ১১টার দিকে গুলির বিকট শব্দে ভয় পেয়ে যাই, তিন বছরের মেয়েকে কোলে আর ছেলেকে বুকে নিয়ে বসে থাকি।পাশের ঘরের একজন এসে ডাকতে থাকলেও তালা লাগানো থাকায় বের হতে পারি নাই।

 “রাত ১২টার আগে বা পরে দিলীপের বাবা গেইট খুলে আমাদের পরিষদ ভবনে নিয়ে যায়। সেখানে আমরা প্রতিমার পেছনে চুপ করে বসে থাকি।হঠাৎ একজনের বাচ্চা কেঁদে উঠলে পাক সেনারা বড় লাইট নিয়ে এসে আমাদের  খুঁজতে শুরু করে।পরে আমার স্বামীকে তারা ধরে ফেলে।আর কোনো পুরুষ আমাদের সঙ্গে ছিল না।”

স্মৃতিচারণ করতে করতে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বকুল বলেন, “স্বামীকে নিয়ে যাচ্ছে, আমি তার হাত টেনে ধরি।কিন্তু তারা লাথি দিয়ে ফেলে দিলে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।জ্ঞান ফিরলে একটি গাছের নিচে আমার স্বামীর লাশ পড়ে থাকতে দেখি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ি আবাসিক এলাকায় ২৬ মার্চ সকালে হামলা হয় মধুর ক্যান্টিনের মালিক মধুসূদন দের বাসায়।

মধুসূদন দের ছেলে মধুর ক্যান্টিনের বর্তমান পারিচালক অরুণ দে তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র; বললেন, তার সামনেই মা, বড়ভাই ও বৌদিকে হত্যা করে পাক সেনারা।

২৫ মার্চ কালরাতের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “প্রথমে গুলির শব্দ, পরে বোমা ও ট্যাংকের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়।আমরা জেগে ছিলাম সারা রাত।বারন্দায় দাঁড়িয়ে শুধু গুলির শব্দ আর বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার শুনতে পাই।পরদিন সকালে বাবাকে খুঁজতে আমাদের বাসায় এসে প্রথমে আমার বৌদিকে গুলি করে।পরে বড় ভাইকে হত্যা করে তারা।এসময় আমার বোন রানুর মুখে ও বুকে গুলি লাগে।”

বাবাকে পাক সেনারা নিয়ে যাওয়ার সময় তার মা বাধা দেন জানিয়ে অরুণ দে বলেন, “খান সেনারা বন্দুক তাক করে বাবাকে নিয়ে যাওয়ার সময় মা বাবাকে জড়িয়ে ধরে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে।তখন খান সেনারা গুলি চালালে মার দুই হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে দেহের বিভিন্ন স্থানের মাংস ছিটকে দেওয়ালে লেগে থাকে।তখন বাবার পায়েও দুটি গুলি লাগলে তিনি সেখানে বসে পড়েন।মার মাথা তখন বাবার কোলে।এরপর খান সেনারা চলে যায়।”

পরে পাক সেনারা হলের কর্মচারী শ্যামলাল ও মোহন রায়কে সঙ্গে নিয়ে এসে মধুসূদন দেকে ধরে নিয়ে যায় বলে জানান অরুণ দে।

“এসময় আমার হাফপ্যান্ট ও গেঞ্জি রক্তে ভিজে গেছে, ফ্লোর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। পানির তেষ্টায় পাশের বাসার রান্নাঘরে পানি খেতে যাই, সেখান থেকে দেখি ওরা বাবাকে জগন্নাথ হলের মাঠে নিয়ে যাচ্ছে।অধ্যাপক জিসি দেবকেও ওই মাঠে আনছে তার বাংলো থেকে।”

তিনি বলেন, “যুদ্ধের পরে শ্যামলাল ও মোহন রায়ের সঙ্গে দেখা হলে বাবার কথা জানতে চেয়েছিলাম।তারা জানান, ওইদিন পাক সেনারা গুলি করে বাবাকে হত্যা করে।”

জগন্নাথ হলের গণকবরের স্মৃতি ফলকে চারজন শিক্ষকসহ ৬৬ জন ছাত্র-কর্মচারির নাম আছে।জহরুল হক হলের স্মৃতিফলকে আট জনের নাম পাওয়া যায়।তবে ওইদিন মারা যান এরও কয়েক গুণ বেশি।

ওই দিন পাক সেনাদের হাতে নিহত সব ছাত্রের নাম স্মৃতিফলকে না থাকার কারণ ব্যাখা করে জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক অসীম কুমার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওইদিন অনেক ছাত্রকে হত্যা করা হয়।হলের কক্ষে কক্ষে হামলা চালিয়ে ছাত্রদের হত্যার পর তাদের কক্ষগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

“নিহতদের সম্পর্কে যাতে কোন ডকুমেন্ট না পাওয়া যায় সেজন্যই কক্ষগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়।”