জালিয়াত আইনজীবীদের ছাড়ে তদন্ত কর্তাকে ভর্ৎসনা

ঢাকার আদালতে জামিন জালিয়াতি করে শতাধিক আসামি মুক্ত করার সঙ্গে জড়িত আইনজীবীদের দোষ তুলে না ধরায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের এক সহকারী পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 March 2017, 04:23 PM
Updated : 22 March 2017, 04:23 PM

ঢাকার পাঁচ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আখতারুজ্জামান বুধবার এই মামলার রায়ে বলেছেন,  “শুনানি না করেই কয়েকজন আইনজীবী জামিননামা দাখিল করে জালিয়াত চক্রের সঙ্গে সুবিধা গ্রহণ করেন। সেসব আইনজীবী ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে এ দুর্নীতি মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে একথা স্বীকার করেন।”

তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক মো. শফিউল্লাহর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বিচারক বলেন, “যে সব আইনজীবী তাদের ১৬১ ধারার জবানবন্দিতে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে বলেছেন যে, আসামিদের জামিন হয় বিচারকের খাসকামরায় । জজ সাহেবের সঙ্গে কথা হয়েছে এবং আসামি আমার আত্মীয় ও পরিচিতজন।

“এই রূপ বক্তব্য প্রদানকারী আইনজীবীদের জবানবন্দি ১৬৪ ধারায় রের্কড করার কোনো উদ্যোগ তদন্ত কর্তা গ্রহণ করেননি। বেইল বন্ড দেন ৬১ জন পৃথক পৃথক আইনজীবী । তাদের সবাইকে ১৬১ ধারায় পরীক্ষা করলেও তিনি শুধু অভিযোগপত্রে ১৯ জনকে সাক্ষীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন।”

এসবের মধ্য দিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা তদন্তে চরম অবহেলা, উদাসীনতা এবং ইচ্ছাকৃতভাবে আইনানুগ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন, যা নিঃসন্দেহে অসদাচরণের পর্যায়ে পড়ে বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়।

শফিউল্লাহর মতো কর্মকর্তা দুদকে কর্মরত থাকলে এবং তদন্তের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত থাকলে ওই প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য মন্তব্য করে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে রায়ের অনুলিপি দুদকে পাঠানোর নির্দেশ দেন বিচারক।

মোট ৭৬টি মামলায় বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে ১০৬ জনকে ভুয়া জামিন দেওয়ায় ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাঁচ কর্মীকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে রায়ে।

দণ্ডিতরা হলেন- ওই আদালতের পেশকার মুসলেহ উদ্দিন, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী শেখ মো. নাঈম এবং উমেদার (অবৈতনিক অস্থায়ী কর্মী) মো. ইসমাইল, মো. আলমগীর ও মো. জাহাঙ্গীর।

আদালতের এই কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজশে ভুয়া জামিন আদেশ তৈরির কথা ৬১ জন আইনজীবী স্বীকার করেছেন বলে উঠে এলেও তাদের শনাক্ত করা হয়নি রায়ে।

ওই সব আইনজীবীদের বিচারের মুখোমুখি করতে বিচারক মামলাটি পুনঃতদন্তের নির্দেশ দিতে পারতেন বলে অভিমত ঢাকা বারের দুজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর।

আইনজীবী পারভেজ হাশেম বলেন , “বিচারক যদি রায়ের পর্যবেক্ষণে এ কথা উল্লেখ করে থাকেন তবে কেন মামলা পুনঃতদন্তের আদেশ দিয়ে ওই সব অসৎ আইনজীবীকে আইনের আওতায় আনলেন না?”

ওই আইনজীবীদের বিচারের মুখোমুখি করার কথা বলেছেন ফৌজদারি মামলা পরিচালনায় অভিজ্ঞ আইনজীবী মো. বোরহান উদ্দিনও।

ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি বোরহান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেহেতু অসৎ আইনজীবীদের একটা অপরাধের ঘটনার সাথে যোগসাজসের সম্পৃক্ততা পেয়েছেন, সে কারণে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করা উচিৎ ছিল।”

তিনি বলেন, “রায়ের পর্যবেক্ষণে আনলেন যে, তাদের অপরাধের সংশ্লিষ্টতা পাচ্ছেন বিচারক এবং মূল অপরাধটাকে নিষ্পত্তি করতে গিয়ে তিনি সহযোগী অন্যান্য আসামি কারও পরিচয় আইনজীবী, কারও পরিচয় আদালতের কর্মচারী, তাদের সুস্পষ্টভাবে শনাক্ত করার জন্য ইনভেস্টিগেশন করার প্রয়োজন ছিল । কারণ মূল অপরাধের সঙ্গে এই অপরাধ কিন্তু হালকাভাবে আসে নাই। অনেকগুলো বিষয় তো, সে কারণে এ মামলার পুনঃতদন্ত হলে  যথাযথ হত। ”

এই মামলায় আসামিপক্ষের হয়ে বিচারের প্রথমদিকে লড়েছেন ঢাকা বারের বর্তমান সভাপতি খোরশেদ আলম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বেশ কয়েকজন আইনজীবী এই জামিন জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিষয়গুলো আইনজীবী সমাজের জন্য স্পর্শকাতর বলে আমি মামলাটি ছেড়ে দিয়েছিলাম। আইনজীবীদের নৈতিক বিষয়গুলো চর্চা হওয়া উচিত।”

জামিন জালিয়াতির এই প্রক্রিয়ায় আদালতের আদেশ গায়েব করা হয় বলেও রায়ে উঠে এসেছে।

“আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা (আদালতের কর্মচারীরা) মামলার নথিপত্র দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারকের কাছে উপস্থাপন করেননি। তার ওপর ৭৬টি মামলার প্রতিটিতেই আসামিপক্ষে জামিনের দরখাস্ত অবৈধভাবে দাখিল করার ক্ষেত্রে তারা আসামিপক্ষের নিয়োজিত কৌশুলিদের সঙ্গে যোগশাজস করে আসামিদের পক্ষে জামিনের দরখাস্ত শুনানি এবং আদালত কতৃর্ক ওই মর্মে কোনো আদেশ প্রচারিত না হওয়া সত্ত্বেও এক অপরের সঙ্গে যোগশাজসে জামিননামা বেআইনিভাবে গ্রহণ করেন।

“পরে রিলিজ অর্ডার (মুক্তির আদেশ) ইস্যু করে ১০৬ আসামিকে অবৈধভাবে কারাগার থেকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করেন।”

এ ধরনের জালিয়াতি ঠেকাতে আদালতের কর্মচারীদের অর্পিত দায়িত্ব (জব ডেসক্রিপশন) সুনির্দিষ্ট করার পরামর্শ দিয়েছেন বিচারক।