সরকারি স্থাপনায় নাশকতার পরিকল্পনা জঙ্গিদের: র‌্যাব

নিষিদ্ধ জেএমবির ‘সরোয়ার-তামিম গ্রুপের’ সদস্যরা সরকারি স্থাপনায় হামলা ও নাশকতার পরিকল্পনা করেছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 March 2017, 05:53 AM
Updated : 21 March 2017, 04:54 PM

আগের দিন রাতভর অভিযানে রাজধানীতে গ্রেপ্তার এই গ্রুপের পাঁচজনের বিষয়ে মঙ্গলবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানান র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আনোয়ার লতিফ খান।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এই পাঁচ জেএমবি সদস্য একটি সেলের সদস্য, যার নেতৃত্বে রয়েছে অলিউজ্জামান ওরফে অলি। ১০-১২ জনের সেলটি বেশির ভাগই কাফরুল ও মিরপুর এলাকার বাসিন্দা।

“এই সেলের সদস্যরা প্রায় সোয়া এক বছর ধরে একসঙ্গে রয়েছে। এরা সম্প্রতি সরকারি স্থাপনায় হামলা ও নাশকতার পরিকল্পনা করেছে।”

র‌্যাব কর্মকর্তা আনোয়ার বলেন, নাশকতা কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য মনির ও সালমান ওরফে আব্দুল্লাহ নামে দুজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে তারা জানতে পেরেছেন। ওই দুজনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

সোমবার গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচজনের মধ্যে অলিউজ্জামান বুয়েটের ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক ছাত্র। বাকিরা হলেন-আনোয়ারুল আলম, আবুল কাশেম, সালেহ আহম্মেদ শিষ, মো. মোহন ওরফে মোহসিন। এদের মধ্যে আনোয়ারুলও বুয়েটের সাবেক ছাত্র।

এই পাঁচ জনের বিরুদ্ধে কোতোয়ালী থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে তাদের রিমান্ডের আবেদন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত।

র‌্যাব কর্মকর্তা আনোয়ার সাংবাদিকদের বলেন, র‌্যাবের কাছে তথ্য ছিল সারোয়ার-তামিম গ্রুপের যারা আত্মগোপনে আছেন, তারা নাশকতার জন্য সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছেন। এরপর বাড্ডা এলাকা থেকে অলিউজ্জামান ও আনোয়ার আটক হন। পরে তাদের থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে অন্যদের আটক করা হয়।

“প্রাথমিকভাবে তারা জঙ্গিবাদে তাদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন।”

র‌্যাবের ভাষ্যে পাঁচ ‘জঙ্গির’ বৃত্তান্ত

অলিউজ্জামান ওরফে অলি: বর্তমানে বহুজাতিক একটি কোম্পানিতে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। তিনি বুয়েট থেকে ২০১২ সালে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। ২০১৫ সালের শেষ দিকে তিনি জেএমবির ‘সারোয়ার-তামীম’ গ্রুপে অর্ন্তভুক্ত হন। তাকে কাফরুল এলাকার একটি জঙ্গি সেল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

সোয়া এক বছর ধরে তিনি মিরপুর কাফরুল এলাকার একটি জঙ্গি সেল পরিচালনা করছেন। তিনি দলের সদস্যদের ইন্টারনেট ব্যবহার ও টেলিগ্রাম আইডি ব্যবহারের দীক্ষা দেন। তার নেতৃত্বে তাদের দলের সদস্যরা ইসলাম অবমাননাকারী বিভিন্ন স্ট্যাটাস ফেইসবুকে পোস্ট করে সহানুভূতি ও সমর্থন আদায়ের জন্য প্রচারণা চালায়।

আনোয়ারুল আলম: একই সময়ে ওলির সঙ্গে বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন; একটি কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করতনে। অলির মাধ্যমে ‘সারোয়ার-তামীম’ গ্রুপে যুক্ত হন। তিনি বোমা তৈরির বিষয়ে পারদর্শী।

আবুল কাশেম: ২০০৪ সালে মিরপুর ১৩  দারুল উলুম মাদ্রাসায় পড়াশোনা শুরু করে। ২০১৪ সালে কামরাঙ্গিরচরের ফরিদাবাদ জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম মাদ্রাসা থেকে দাওরা হাদিস পাশ করে। এরপর টিউশনি করে জীবিকার জন্য কাফরুলে থাকা শুরু করেন। ২০১৬ সালের শুরুর দিকে তার সাথে অলিউজ্জামানের পরিচয় হলে অলির মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন।

ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞান থাকার কারণে দলের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে ‘আকিদাগত’ বিষয় নিয়ে আলোচনায় তিনি মূল ভূমিকা পালন করতেন। এছাড়া ইন্টারনেটের প্রচারের জন্য আরবীতে লেখা বিভিন্ন উগ্রবাদী মতাদর্শ বাংলায় ভাষান্তর করতেন তিনি। সদস্যদের কাছ থেকে মাসিক ইয়ানত (চাঁদা) সংগ্রহ করে অলির নির্দেশে বিভিন্ন স্থানে দিয়ে আসতেন।

সালেহ আহাম্মেদ শীষ: মিরপুর সেনপাড়া বায়তুল মামুর মাদ্রাসা থেকে ২০১২ সালে দাখিল পাশ করে মিরপুর বাঙলা কলেজে ডিগ্রী (পাস) কোর্সে ভর্তি হন। মিরপুর এলাকায় থাকার কারণে অলিউজ্জামান ওরফে অলির সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং অলির কাছে এসে উগ্র ধর্মীয় ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়। সে সংগঠনে নিয়মিত ইয়ানত দিত এবং চট্টগ্রামে একবছরের আগে অস্ত্র চালনার বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন।

তার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গি মুফতি হান্নানের আত্মীয়তা রয়েছে বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাব জেনেছে।

মো. মোহন ওরফে মহসিন: মিরপুর এলাকায় তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। ২০১৪ সাল থেকে ঢাকায় বিভিন্ন পরিবহনের হেল্পার হিসেবে কাজ করেছেন। ছোটবেলা থেকে কাফরুলে অবস্থান করছেন। আবুল কাশেম তাকে উগ্রবাদিতায় আকৃষ্ট করে। ২০১৭ সালের মার্চের শুরুতে নিজ পরিবার ছেড়ে বিচ্ছিন্ন হন। ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রামে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন তিনি।

এই পাঁচজনের কাছ থেকে বেশ কিছু উগ্র মতবাদের বই ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম, খেলনা অস্ত্র, নগদ ৩ লাখ ১৪ হাজার টাকা উদ্ধার করার কথা সাংবাদিকদের জানান আনোয়ার লতিফ খান।

গত বছরের ৮ অক্টোবর ঢাকার আশুলিয়ার এক বাড়িতে র‌্যাবের অভিযানের সময় পাঁচতলা থেকে পড়ে একজনের মৃত্যু হয়। পরে র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওই ব্যক্তির প্রকৃত নাম সারোয়ার জাহান এবং তিনি শায়খ আবু ইব্রাহীম আল হানিফ নাম নিয়ে তামীম চৌধুরীর সঙ্গে মিলে জেএমবির নতুন একটি অংশকে সংগঠিত করেন।

সরোয়ার নিহত হওয়ার আগে ২৭ অগাস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় এক জঙ্গি আস্তনায় অভিযানে নিহত হন তামিম আহমেদ চৌধুরীসহ তিনজন।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জেএমবির এই গ্রুপকেই গুলশান ও শোলাকিয়াসহ সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলাগুলোর অধিকাংশ ঘটনায় দায়ী করে আসছে। এই অংশটিকে পুলিশ বলছে ‘নব্য জেএমবি’, র‌্যাব বলছে সারোয়ার তামিম গ্রুপ।

গতবছর জুলাই মাসে গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক অভিযানের মধ্যে বেশ কিছুদিন পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও মার্চের শুরু থেকে বেশ কয়েকটি ঘটনার মধ্য দিয়ে জঙ্গিরা নতুন করে তাদের তৎপরতার জানান দিতে শুরু করে।

এর মধ্যে গত শুক্রবার র‌্যাবের একটি ব্যারাকের সীমানায় ঢুকে পড়ার পর শরীরে বাঁধা বোমার বিস্ফোরণে নিহত হয় সন্দেহভাজন এক জঙ্গি। পরদিন ভোরে খিলগাঁওয়ে একটি তল্লাশি চৌকিতে গুলিতে নিহত হন এক ব্যক্তি, যিনি বিস্ফোরক বহন করছিলেন বলে র‌্যাবের ভাষ্য।

এর আগে গত ৭ মার্চ কুমিল্লায় একটি বাসে তল্লাশির সময় পুলিশের দিকে বোমা ছোড়ার পর ধরা পড়ে দুই জঙ্গি। তাদের মধ্যে একজনকে সঙ্গে নিয়ে ওই রাতে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও বোমা উদ্ধার করে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।

এরপর ১৫ মার্চ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড পৌর এলাকার আমিরাবাদের এক বাড়ি থেকে বিস্ফোরকসহ এক জঙ্গি দম্পতিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রেমতলা এলাকায় আরেক বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। সেখানে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ও গুলিতে এক নারীসহ চার জঙ্গি নিহত হন। পরে বোমায় বিক্ষত এক শিশুর লাশ পাওয়া যায়।

কুমিল্লা ও সীতাকুণ্ডে গ্রেপ্তার ও নিহত সবাই নব্য জেএমবির সদস্য বলে পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা।