রিভিউ খারিজ, ফাঁসিতেই ঝুলতে হবে মুফতি হান্নানকে

জঙ্গি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ তিনজনকে আপিল বিভাগের দেওয়া প্রাণদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ করে দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 March 2017, 06:59 AM
Updated : 19 March 2017, 12:45 PM

সিলেটে সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপর গ্রেনেড হামলা চালিয়ে পুলিশসহ তিনজনকে হত্যার দায়ে হরকাতুল জিহাদের এই তিন জঙ্গির দণ্ড কার্যকরে আর কোনো আইনি বাধা থাকল না।

আদালতের চূড়ান্ত বিচারেও ফাঁসির রায় বহাল থাকা বাকি দুই আসামি হলেন শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুল ও দেলোয়ার ওরফে রিপন।

নিয়ম অনুযায়ী তারা এখন কেবল কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনার কথা জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারেন। এর নিষ্পত্তি হলেই সরকার কারাবিধি অনুযায়ী দণ্ড কার্যকর করবে।

প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে তিন সদস্যের আপিল বেঞ্চ রোববার এই রায় ঘোষণা করে।

রিভিউ শুনানিতে আসামিপক্ষে শুনানি করেন এনকে সাহা। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের বলেন, “আপিল নিষ্পত্তি হওয়ার পরই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু রিভিউ আবেদন করায় সেটি স্থগিত ছিল। যেহেতু রিভিউ আবেদন খারিজ হয়ে গেছে, তাই কারা কর্তৃপক্ষের মৃতুদণ্ড কার্যকর করতে এখন আর কোনো বাধা নেই।”

মুফতি হান্নানসহ তিন আসামি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কিনা জানতে চাইলে নিখিল কুমার সাহা বলেন, “এটা তাদের সিদ্ধান্ত। আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।”

সিলেটে হযরত শাহজালালের মাজার প্রাঙ্গণে ২০০৪ সালের ২১ মে ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরী গ্রেনেড হামলার মুখে পড়েন।

এতে ঘটনাস্থলেই পুলিশের এএসআই কামাল উদ্দিন নিহত হন। এছাড়া পুলিশ কনস্টেবল রুবেল আহমেদ ও হাবিল মিয়া নামের আরেক ব্যক্তি মারা যান হাসপাতালে। আনোয়ার চৌধুরী ও সিলেটের জেলা প্রশাসকসহ অন্তত ৪০ জন ওই ঘটনায় আহত হন।

আপিল বিভাগ গত বছরের ৭ ডিসেম্বর এ মামলার আপিলের রায় ঘোষণা করে। গতবছর ১১ ফেব্রুয়ারি তিন আসামিকে হাই কোর্টের দেওয়া সর্বোচ্চ সাজার রায়ই তাতে বহাল থাকে।   

এ মামলার বাকি দুই আসামি মহিবুল্লাহ ও আবু জান্দালকে হাই কোর্ট যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল। আপিল না করায় তাদের ওই সাজাই বহাল থাকে।

দণ্ডিত পাঁচ আসামির সবাই কারাগারে আছেন। তাদের মধ্যে মুফতি হান্নানসহ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিনজন আছেন গাজীপুরের কাশিমপুরে হাই সিকিউরিটি কারাগারে।

গত ৬ মার্চ একটি মামলার শুনানি শেষে হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নান ও তার সহযোগীদের আদালত থেকে কাশিমপুর কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়ার পথে টঙ্গীতে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে তাদের ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়।

সেই প্রসঙ্গ টেনে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “সম্প্রতি প্রিজন ভ্যানে হামলা এবং গত কয়েকদিনে আত্মঘাতি জঙ্গি হামলার চেষ্টা মুফতি হান্নানকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্যই। রাষ্ট্র ইতোমধ্যে সে ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করছে।”

‘তাদের মুক্তি দেওয়া যায় না’

রিভিউ শুনানিতে আসামিপক্ষের আইনজীবী নিখিল কুমার সাহা বলেন, মুফতি হান্নান, শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুল ও দেলোয়ার ওরফে রিপন গত ১০ বছর ধরে কারাভোগ করে আসছে। সুতরাং তাদের মুত্যুদণ্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হোক।

বিচারক তখন বলেন, “তারা যে অপরাধ করেছে তা পূর্বপরিকল্পিত একটি অপরাধ। ব্রিটিশ কূটনীতিবিদ ও তার সফরসঙ্গীদের হত্যা করার জন্যই এ হামলা চালানো হয়েছিল। এ অভিযোগের দায় থেকে তাদের মুক্তি দেওয়া যায় না।

“তাছাড়া মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হওয়ার কারণে এবং তাদের জেলে থাকার কারণে আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন দণ্ড দেওয়ার আইনি ভিত্তি নেই।”

মুফতি হান্নান

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টাসহ হরকাতুল জিহাদের ১৩টি নাশকতামূলক ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যার পেছনে মূল ব্যক্তি বলা হয় মুফতি হান্নানকে।

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় মুফতি হান্নানের বাড়ি৷ গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসায় তিনি লেখাপড়া করেছেন। ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর ঢাকার বাড্ডা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

২০০০ সালের ২০ জুলাই সেই কোটালীপাড়াতেই শেখ হাসিনার সভামঞ্চের কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা হয়। মুফতি হান্নান ওই মামলার আসামি।

রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনাতেও তার মৃত্যুদণ্ডের রায় এসেছে আদালতে। ওই হত্যা মামলায় মুফতি হান্নানসহ আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের করা আপিলের ওপর শুনানি প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে হাই কোর্টে।

পরের ধাপ প্রাণভিক্ষা

দণ্ড কার্যকরের আগে মুফতি হান্নান ও তার দুই সহযোগীর শেষ আইনি সুযোগ ছিল রিভিউ আবেদন। তা খারিজের মধ্য দিয়ে আইনি লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি হয়েছে। এখন সংবিধান অনুসারে শেষ সুযোগে দণ্ডাদেশ পাওয়া আসামি প্রাণভিক্ষা চাইতে পারেন।

আসামি তা না চাইলে বা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা না পেলে সরকার দিনক্ষণ ঠিক করে কারা কর্তৃপক্ষকে ফাঁসি কার্যকরের নির্দেশ দেবে। তার আগে স্বজনেরা কারাগারে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে পারবেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “রায় জানার পর কারা কর্তৃপক্ষ আসামিদের কাছে জিজ্ঞেস করবেন- রাষ্ট্রপতির কাছে তারা প্রাণভিক্ষা চাইবেন কিনা। তারা যদি প্রাণভিক্ষা চান, সেই দরখাস্ত রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। আর যদি না চান, তাহলে কারা কর্তৃপক্ষ তাদের পরবর্তী প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাবে।”

মাহবুবে আলম বলেন, কারাবিধি অনুযায়ী সাত দিনের আগে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যাবে না। আবার তা কার্যকর করতে হবে ২১ দিনের মধ্যে।

“কাজেই জেলকোড মেনেই সমস্ত আইনি প্রক্রিয়ার পর আসামিদের ব্যাপারে কারা কর্তৃপক্ষ ও রাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নেবে।”

এর আগে ঝালকাঠিতে দুই বিচারককে বোমা মেরে হত্যার দায়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআ’তুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের সাত জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।

এর মধ্যে জেএমবির শীর্ষ দুই নেতা শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইসহ ছয় শীর্ষ জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর হয় ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ।

এ মামলার অপর আসামি আসাদুল ইসলাম আরিফের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় গতবছর ১৬ অক্টোবর।

শায়খ আবদুর রহমানের ফাঁসি কার্যকর হয় কুমিল্লা কারাগারে। সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই ও আবদুল আওয়ালকে ফাঁসি দেওয়া হয় ময়মনসিংহ কারাগারে। খালেদ সাইফুল্লাহর ফাঁসি হয় পাবনা কারাগারে।

আর কাশিমপুর কারাগারে ফাঁসি দেওয়া হয় আতাউর রহমান সানি ও ইফতেখার হাসান মামুনকে । সর্বশেষ আসাদুল ইসলাম আরিফের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় খুলনা জেলা কারাগারে

মামলা বৃত্তান্ত

সিলেটে হযরত শাহজালালের মাজার প্রাঙ্গণে ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলায় তিনজনের মৃত্যুর ঘটনায় ২০০৪ সালের ২১ মে কোতোয়ালি থানায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ।

তদন্ত শেষে ২০০৭ সালের ৭ জুন হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান, তার ভাই মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে মফিজ ওরফে অভি, শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুল ও দেলোয়ার ওরফে রিপনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

যথাযথ ঠিকানা না থাকায় মুফতি মঈন উদ্দিন ওরফে আবু জান্দাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ ওরফে খাজার নাম প্রথমে বাদ দেওয়া হলেও পরে তাকে যুক্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ওই বছর নভেম্বরে হয় অভিযোগ গঠন।

৫৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ২০০৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক সামীম মো. আফজাল রায় ঘোষণা করেন।

আসামিদের মধ্যে মুফতি হান্নান, বিপুল ও রিপনকে মৃত্যুদণ্ড এবং মহিবুল্লাহ ও আবু জান্দালকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

ওই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের (মুত্যুদণ্ড অনুমোদনের আবেদন) শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রায় দেয় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি আমির হোসেনের হাই কোর্ট বেঞ্চ।

তাতে আসামিদের আপিল খারিজ হয়ে যায়, মুফতি হান্নানসহ তিন আসামির মৃত্যুদণ্ড এবং দুইজনের যাবজ্জীবন দণ্ড বহাল থাকে।

ওই রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করেন হান্নান ও বিপুল। আর দেলোয়ারের পক্ষে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আইনজীবী নিয়োগ করা হয়। ২০১৬ সালের ৭ ডিসেম্বর সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়েও ওই তিন আসামির সর্বোচ্চ সাজার সিদ্ধান্তই বহাল থাকে।

আপিল বিভাগের রায় হাই কোর্ট হয়ে নিম্ন আদালতে যাওয়ার পর বিচারিক আদালত মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে এবং তা গত ৩ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে পৌঁছায়। সেখানেই আসামিদের মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনানো হয়।

এরপর গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রিভিউ আবেদন করেন তিন আসামি। শুনানি শেষে রোববার আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দেয়।