প্রধানমন্ত্রীকে ভুল রিপোর্ট দেওয়া হচ্ছে: প্রধান বিচারপতি

প্রধানমন্ত্রীকে ভুল তথ্য দিয়ে একটি মহল বিচার বিভাগের সঙ্গে প্রশাসনের দূরত্ব তৈরি করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 March 2017, 12:19 PM
Updated : 18 March 2017, 12:36 PM

শনিবার বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের ‘অনলাইন অ্যাপ্লিকেশন রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম’ উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এই অভিযোগ তোলেন তিনি।

প্রধান বিচারপতি বলেন, “একটি মহল বিচার বিভাগের সাথে প্রশাসনের দূরত্ব তৈরি করে দিচ্ছে। বিচার বিভাগের ছোটো ছোটো সমস্যাগুলো ঠিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে না, বরং তা উল্টোভাবে সরকার প্রধানের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে। প্রশাসনকে ভুল বোঝানো হয়েছে। বলা হচ্ছে বিচার বিভাগ প্রশাসনের প্রতিপক্ষ।

“এটা অত্যন্ত ভুল ধারণা। কোনোদিনই বিচার বিভাগ প্রশাসন বা সরকারের প্রতিপক্ষ হয়নি। আমি আশা রাখব, বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনে যারা আছেন, তারা ভুল রিপোর্ট দেবেন না সরকার প্রধানকে। তারা ঠিক রিপোর্ট দেবেন, যাতে বিচার বিভাগ এবং সরকার সুন্দরভাবে চলে।”

রাষ্ট্রের দুটি অঙ্গের মধ্যে সমন্বয় না থাকার সমস্যার দিকটি তুলে ধরে প্রধান বিচারপতি বলেন, “যদি বিচার বিভাগ ও সরকারের মধ্যে সুসম্পর্ক না থাকে, তাহলে সরকারই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকার এবং এক্সিকিউটিভে যারা আছেন, তারা যদি এগিয়ে আসেন তাহলে সরকার এবং বিচার বিভাগের মধ্যে সমন্বয় স্থাপন করা যায়।”

সরকার ও প্রশাসন এই উপলব্ধি হবে এবং ভবিষ্যতে আর কোনো ভুল বোঝাবুঝি হবে না বলে আশা প্রকাশ করেন বিচারপতি সিনহা।

অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ সংক্রান্ত বিধিমালার গেজেট প্রকাশ নিয়ে সরকার ও বিচার বিভাগের টানাপড়েনের মধ্যে প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্য এল।

বিচার বিভাগ ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করতে পারছে না দাবি করে তিনি বলেন, “সংবিধান এবং আইনের আওতায় বিচার বিভাগকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সে অনুযায়ী কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। সে মতো কাজ করতে দিলে দেশে দুর্নীতি, অপরাধ প্রবণতা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থাকবে না।”

“যখন কোনো রাজনৈতিক সরকার শাসনতন্ত্র ঠিকমতো পরিচালনা করবে না, তখন বিচার বিভাগ এগিয়ে আসবে। না হলে সেই দেশের সভ্যতা থাকবে না,” এই প্রসঙ্গে বলেন তিনি।

বিচারপতি সিনহা বলেন, রাজনৈতিক সরকারগুলোর চিন্তা-চেতনায় কিছু ‘বাড়াবাড়ি’ থাকে। সে কারণেই বিচার বিভাগ। না হলে তো প্রশাসনই বিচার করত।

বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এ দুটি হত্যাণ্ডের পর রাজনীতিকরাই তা আইনসিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। এক সময় এই বিচার বিভাগ এগিয়ে আসল। তাদের বিচার করল।”

যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি নিয়ে বিচারপতি সিনহা বলেন, “স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরে যুদ্ধাপরাধের বিচার ছিল না। আমাদের বিচারকরা যখন এর বিচার শুরু করল তখন সারা বিশ্বে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। এটা কী হচ্ছে? এটা হচ্ছে না, ওটা হচ্ছে না। তারা লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা ঢাললো।

“তাদের প্ররোচনায় আমাদের এখানেও তথাকথিত স্বাধীনতার পক্ষের লোকেরা হৈ চৈ আরম্ভ করল পরোক্ষভাবে। কিন্তু বিচারের সঙ্গে যারা ছিলেন, তারা কোনো কথা বললেন না, তারা বিচার করে গেলেন। এমন বিচার করলেন, এখন কিন্তু তাদের এই রায়গুলো নিয়ে পৃথিবীর কোথাও সমালোচনা হচ্ছে না।”

তবে পাকিস্তান আমল থেকে ইতিহাস পর্যালোচনা করে বিচারপতি সিনহা বলেন, “বিচার বিভাগের যত ক্ষতি হয়েছে তা করেছে আমাদের বিচার বিভাগের কিছু সদস্য। আমরাই বেশি ক্ষতি করেছি।”

বিচারক স্বল্পতার পরিসংখ্যান তুলে ধরে প্রধান বিচারপতি বলেন, “পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় জনসংখ্যা, মামলা সংখ্যার অনুপাতে সবচেয়ে কম বিচারক আমাদের দেশে। সেখানে যদি ৩০৭টি পদ খালি থাকে তাহলে মামলা ডেটলক তো হবেই।”

বাংলাদেশে ছয়টি জেলা জজ, নয়টি অতিরিক্ত জেলা জজ, ১৬টি যুগ্ম জেলা জজ, ১২৩টি সহকারী জেলা জজ ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসিতে ১৫৯ পদসহ মোট ৩০৭টি পদ খালি বলে জানান তিনি।

‘অনলাইন অ্যাপ্লিকেশন রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম’ আরও আগে শুরু হওয়া দরকার ছিল মন্তব্য করে প্রধান বিচারপতি বলেন, সরকারের যে ডিজিটাইজেশনের কথা বলা হচ্ছে, এর পেছনে অনেক টাকাও ব্যয় করা হচ্ছে। কিন্তু বিচার বিভাগ ডিজিটাইজেশনের জন্য কোনো টাকা দেওয়া হচ্ছে না।

“ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত প্রশাসনের ডিজিটাইজেশনের প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের ডিজিটাইজেশনের জন্য ইউএনডিপির সাহায্য নিতে হচ্ছে, এটা দুঃখজনক। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এটি আরও অনেক আগেই করা যেত।”

বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ও আপিল বিভাগের বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী সভাপতির বক্তব্যে এ কমিশনকে দেশের সবচেয়ে কার্যকরি কমিশন হিসেবে তুলে ধরে নিজস্ব ভবনের দাবি করেন।

অনুষ্ঠানে আপিল ভিাগের বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহাব মিঞা বলেন, এই অ্যাপ্লিকেশনটি চালু হওয়ায় দেশে বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছ হবে।

আনুষ্ঠানে বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী, বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক বিচারপতি খোন্দকার মূসা খালেদ, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির কান্ট্রি ডিরেক্টর সুদীপ্ত মুখার্জি বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের সচিব পরেশ চন্দ্র শর্ম্মা। এরপরই প্রধান অতিথি ও সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির কান্ট্রি ডিরেক্টর সুদীপ্ত মুখার্জিকে ক্রেস্ট প্রদান করা হয়।

অনুষ্ঠানে সবশেষে প্রধান বিচারপতি বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস (বিজেএস) কমিশনের অনলাইন এপ্লিকেশন রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম উদ্বোধন করেন।

জুডিশিয়াল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে এখন থেকে www.bjsc.gov.bd ওয়েবসাইটের মাধ্যমে দেশ ও বিদেশের যে কোনো স্থান থেকে অলাইনে নিবন্ধন করা যাবে।