সীতাকুণ্ডের আস্তানায় ‘আত্মঘাতী বিস্ফোরণ’, ৪ জঙ্গি নিহত

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের এক দোতলা বাড়ি ঘিরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দীর্ঘ ১৯ ঘণ্টার অভিযানের সমাপ্তি ঘটেছে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ও গুলিতে এক নারীসহ চার ‘জঙ্গির’ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।   

মোস্তফা ইউসুফবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 March 2017, 04:50 AM
Updated : 16 March 2017, 11:23 AM

পৌর এলাকার ৫ নম্বর প্রেমতলা ওয়ার্ডে ‘ছায়ানীড়’ নামের ওই দ্বিতল ভবন বুধবার বিকাল থেকে ঘিরে রেখেছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। শুরুতে জঙ্গিদের তরফ থেকে কয়েক দফা গ্রেনেড হামলা এবং রাতভর গোলাগুলির পর বৃহস্পতিবার সকালে শুরু হয় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট ও সোয়াটের ‘অপারেশন অ্যাসল্ট সিক্সটিন’

সোয়াট সদস্যরা পাশের একটি বাড়ি থেকে ছাদ হয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলে জঙ্গিরা ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে সেখানে বড় ধরনের আত্মঘাতি বিস্ফোরণ ঘটায় বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান।     

পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি সফিকুল ইসলাম সকাল সোয়া ১০টায় ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা এখন পর্যন্ত চারটি ডেডবডি সেখানে দেখেছি। তাদের দুজনের শরীরে ছিল সুইসাইড ভেস্ট। বিস্ফোরণে তাদের মৃত্যু হয়েছে। দেহগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। দুজন মারা গেছে পুলিশের গুলিতে। ভেতরে আর কেউ নেই।”

এই অভিযানে জঙ্গিদের ছোড়া গ্রেনেডে তিন পুলিশ সদস্য এবং গ্রিল কাটতে গিয়ে ফায়ার ব্রিগেডের এক সদস্য আহত হয়েছেন বলে জানান তিনি।

সকাল ১০টার পর অভিযান প্রাথমিকভাবে সমাপ্ত ঘোষণা করা হলেও পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিটের সদস্যরা ভেতরে কাজ করছিলেন। 

ডিআইজি সফিকুল বলেন, “জঙ্গিরা দুটি ঘরে ছিল। সেখানে প্রচুর বিস্ফোরক রয়েছে। ছাদেও প্রচুর বোমার মজুদ দেখা গেছে। আমাদের অপারেশন শেষ হয়েছে। তবে ভবনটি নিরাপদ করার জন্য বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল কাজ করছে।”

দুই তলা ছায়ানীড়ের আটটি ইউনিটের একটিতে আস্তানা গেড়েছিল জঙ্গিরা। বাকি ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সারা রাত আতঙ্কের মধ্যে ভেতরে আটকে থাকতে হয়। সকালে নারী-শিশুসহ ২০ জনকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায় পুলিশ।

সফিকুল ইসলাম বলেন, “সাধারণ নাগরিকদের বের করে আনার জন্য গত রাতে আমরা কয়েকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। আজ সকালে তারা আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটানোর পর আবার চেষ্টা শুরু করি। পরে জানালার গ্রিল কেটে বিভিন্ন ঘরের বাসিন্দাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসি।”

তিনি বলেন, নিহত চার জঙ্গি নব্য জেএমবির সদস্য ছিলেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন তারা।

“ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের আশপাশে বড় বড় উন্নয়ন কাজ চলছে। সেখানে অনেক বিদেশি নাগরিক কাজ করছেন। হয়তো তাদের টার্গেট করেই এখানে গ্রেনেড ও বিস্ফোরক মজুদ করা হয়েছিল।”

কয়েকশ মিটার ব্যবধানে জোড়া আস্তানা

সীতাকুণ্ড পৌর এলাকার নামার বাজার ওয়ার্ডের আমিরাবাদ এলাকায় এক বাড়িওয়ালার কাছ থেকে খবর পেয়ে বুধবার বিকাল ৩টার পর পুলিশের এই অভিযানের সূচনা হয়। সাধন কুটির নামের দোতলা ওই বাড়ির নিচ তলা থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরকসহ জসিম ও আর্জিনা নামের এক দম্পতিকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পুলিশ বলছে, তারা দুজনই নব্য জেএমবির সদস্য। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেই কয়েকশ মিটার দূরে প্রেমতলায় আরেক জঙ্গি আস্তানার কথা পুলিশ কর্মকর্তারা জানতে পারেন।  

বিকাল ৪টার পর প্রেমতলার ওই বাড়িতে অভিযানে গিয়ে শুরুতেই হামলার মুখে পড়েন পুলিশ সদস্যরা। ছায়নীড়ের দোতলা থেকে ছোড়া একটি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়ে পায়ে আঘাত পান সীতাকুণ্ড থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোজাম্মেল হক।

পরে সীতাকুণ্ডের ওসি ইফতেখার হাসানের নেতৃত্বে আরেকটি দল এসে বাড়িটি ঘিরে ফেলে। পুলিশের ঘেরাওয়ের মধ্যে থেকেই ওই বাড়ি থেকে জঙ্গিরা দফায় দফায় গ্রেনেড ছুড়তে থাকে। মাঝে মাঝে গোলাগুলিও চলতে থাকে।

সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে চট্টগ্রাম পুলিশের সোয়াট সদস্যরা ওই বাড়ি ঘিরে অবস্থান নেন। রাত ৯টার দিকে সেখানে হাজির হয় সাঁজোয়া যান।

অভিযানের প্রস্তুতি চলার মধ্যেই ঢাকা থেকে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, সোয়াট ও বোমা নিস্ক্রীয়কারী দল এবং পুলিশ সদরদপ্তরের ‘এলআইসি’ দলের সদস্যরা সীতাকুণ্ডে পৌঁছান।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ছানোয়ার হোসেনও ওই দলের সঙ্গে সীতাকুণ্ডে যান, যিনি এর আগে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন জঙ্গিবিরোধী অভিযানে অংশ নিয়েছেন।

চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের অতিরিক্ত সুপার (উত্তর) মসিউদ্দোল্লাহ রেজা জানান, ঢাকা থেকে পুলিশের এই দল যাওয়ার পর ভবনটিতে চূড়ান্ত অভিযানে যাওয়ার বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়।

এরই মধ্যে ওই ভবনে আটকা পড়া পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে পুলিশ। তারা বাইরে আসতে চাইলেও পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার স্বার্থে দরজা বন্ধ করে ভেতরে অবস্থান করতে বলা হয়।

‘অপারেশন অ্যাসল্ট সিক্সটিন’

বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে শুরু হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘অপারেশন অ্যাসল্ট সিক্সটিন’। পুলিশ বাইরে থেকে গুলি চালালে জঙ্গিরা একের পর এক শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটায়।

এ সময় সাত থেকে আট মিনিট ধরে টানা গুলির পাশাপাশি সাত-আটটি বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান দূরে সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বে নিয়োজিত সংবাদকর্মীরা। এক পর্যায়ে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা।

কিছুক্ষণ পর পুলিশের ঘেরাওয়ের ভেতর থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে দুই সোয়াট সদস্যকে নিয়ে যেতে দেখা যায়।

অভিযান শেষে ব্রিফিংয়ে এসে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি সফিকুল ইসলাম বলেন, চূড়ান্ত অভিযান শুরুর পর পাশের একটি ভবনের দোতলা থেকে সোয়াট সদস্যারা ছায়ানীড়ের ছাদে যান।

“এ সময় ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিতে দিতে বিস্ফোরকের ভেস্ট পড়া দুইজন ছাদে চলে আসে। তারা বিস্ফোরণ ঘটাতে যাচ্ছে দেখে সোয়াট সদস্যরা গুলি করে। এতে এক জঙ্গি মাটিতে পড়ে গেলেও অন্যজন বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম হয়।”

সফিকুল জানান, নিহত চার জঙ্গির মধ্যে দুজনের শরীরে সুইসাইড ভেস্ট ছিল। বাকি দুজনের মৃত্যু হয়েছে পুলিশের গুলিতে।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের ছানোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আত্মঘাতী বিস্ফোরণে যারা নিহত হয়েছেন তাদের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে, চেনার উপায় নেই।

সফিকুল বলেন, বুধবার আরেক আস্তানা থেকে গ্রেপ্তার জঙ্গি দম্পতিকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও তারা মুখ খোলেননি। ঢাকার পুলিশের আলাদা দলের মাধ্যমে তাদের আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

চট্টগ্রামে জঙ্গি দমনে বেশ কিছুদিন পুলিশের তেমন কোনো তৎপরতা দেখা না গেলেও সম্প্রতি কুমিল্লায় একটি বাসে তল্লাশির সময় পুলিশের দিকে বোমা ছোড়ার ঘটনার পর নড়েচড়ে বসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।

গত ৭ মার্চ কুমিল্লায় দুই জঙ্গিকে আটক করার পর তাদের একজনকে নিয়ে ওই রাতেই মিরসরাইয়ের একটি বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় ২৯টি হাতবোমা, নয়টি চাপাতি, ২৮০ প্যাকেট বিয়ারিংয়ের বল এবং ৪০টি বিস্ফোরক জেল।

এরপর চট্টগ্রাম নগরী ও জেলার বিভিন্ন স্থানে ভাড়াটিয়াদের তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি এলাকায় এলাকায় ‘ব্লক রেইড’ দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়ার কথা জানান চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার নূরে আলম মিনা।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে ঢাকা থেকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন লিটন হায়দার ও গোলাম মুজতবা ধ্রুব ]