ওই ঘটনার দুদিন পর মঙ্গলবার ফ্লাইওভারের নির্মাণাধীন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, লোহার রড, গার্ডারসহ নির্মাণসামগ্রী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়েছে রাস্তায়। ফ্লাইওভারের যেসব অংশে গার্ডার বসানোর কাজ চলছে সেখানেও নিচে কোনো বেষ্টনি রাখা হয়নি। পথচারীদের কোনো সতর্কীকরণ সাইনবোর্ডও নেই। কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকায় এই ঝুঁকিপূর্ণ নির্মাণযজ্ঞের মধ্য দিয়ে চলছে সাধারণের চলাচল।
যেসব শ্রমিক নির্মাণ কাজ করছেন তাদেরও নেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা, যদিও ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় শ্রমিক- পথচারীদের নিরাপত্তার সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে।
ঢাকা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ এ বলা হয়, কোনো স্থাপনা নির্মাণের সময় নির্মাণ এলাকা এবং এর চারপাশে যথোপযুক্ত ও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকতে হবে।
রাস্তা বা জনসাধারণের চলাচলের স্থানে নির্মাণকাজ করা হলে সেখানে অস্থায়ী ঘের, জীবন রক্ষাকারী বাধা এবং বিকল্প চলাচল পথ তৈরি করে জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে এতে। এছাড়া নির্মাণকাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে বিধিমালায়।
এই ঘটনা ছাড়াও ওই ফ্লাইওভার নির্মাণ এলাকায় প্রায়ই ছোটখাট দুর্ঘটনা ঘটছে বলে স্থানীয়দের ভাষ্য।
মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার বিক্রমপুর ফার্মার মালিক ইসমাইল খান ফ্লাইওভার থেকে ছিটকে পড়া একটি লোহার টুকরো দেখিয়ে বলেন, গত শনিবার এই লোহার টুকরাটি নিচে পড়েছে। তবে সে সময় কেউ সেখানে না থাকায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি।
“আমার দোকানের সামনে একটি মোটরসাইকেলের ওপর এটা পড়ে। মোটরসাইকেলের তেলের ট্যাংক বাঁকা হয়ে গেছে। ভাগ্য ভালো কেউ ছিল না। ঝালাই করার সময় প্রায়ই উপর থেকে লোহার গুঁড়া লোকজনের উপর পড়ে।”
এর ভেতর দিয়েই রাজারবাগের বাসা থেকে যাতায়াত করতে হয় সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মাহাথির মোহাম্মদকে।
রোববারের ওই ঘটনার পর এখন সড়কের এই অংশ পার হতে ভয় করে বলে জানান তিনি।
“এইখানে চারপাশে রড, নানা রকম জিনিসপত্র রাখা। মাথার উপরেও কাজ করে। রাস্তায় কাদা থাকলে এসবের ভিতর দিয়া যাইতে হয়। ভয় লাগে, কিন্তু এছাড়া উপায় কী?”
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী বলেন, “এ এলাকায় অনেক জায়গায় হাঁটার ফুটপাতও নেই। ফলে বাধ্য হয়েই ফ্লাইওভারের নিচের এসব নির্মাণসামগ্রীর ভেতর দিয়ে যেতে হয়। কোথাও কোনো সাইনবোর্ডও নেই যে, কোন দিকে যাওয়া যাবে, কোন দিকে যাওয়া যাবে না। এজন্য অনেক ভয় লাগে। কখন মাথার ওপর কী এসে পড়ে!”
জনসাধারণকে ঝুঁকিতে রাখা এই উন্নয়নযজ্ঞের কর্মীরা নিরাপত্তা ছাড়াই কাজ করছেন।
দুদিন আগে যেখানে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে, তার কাছেই মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় ফ্লাইওভারে উঠার র্যাম্পের দেওয়াল ঢালাইয়ের জন্য লোহার ঝালাই কর্মরতদের এদিনও দেখা যায় হেলমেট ছাড়া। নেই সেইফটি বেল্টও।
মৌচাক মোড়েও কয়েকজন শ্রমিককে নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়া কাজ করতে দেখা যায়।
অনিরাপদভাবে কাজ করার কারণ জানতে চাইলে পারভেজ নামে একজন শ্রমিক দাবি করেন, তারা ওই সব সরঞ্জাম পরেই কাজ করেন।
“দুপুরে খাইতে গেছিলাম বইলা পরি নাই।”
তবে ওই এলাকা ঘুরে কাউকেই নিরাপত্তা সরঞ্জাম পরতে দেখা যায়নি।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাইটের নিরাপত্তায় আমাদের লোক আছে। তারা সব সময় এগুলো মনিটর করে। কিন্তু তারপরও মাঝে মধ্যে এরকম ঘটনা ঘটে যায়।”
তিনি বলেন, শ্রমিকদের নিরাপত্তায় ব্যবস্থা থাকলেও তারা এ বিষয়ে অসচেতন।
“আমরা তাদের হেলমেট, সেইফটি সু, বেল্ট সবই দেই। কিন্তু তারা অভ্যস্ত না, এসব পরতে চায় না। বলে হেলমেট ভারী লাগে, গরম লাগে।”
রোববারের ঘটনার পর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
“আমরা অলরেডি ব্যবস্থা নিয়েছি। আপনি আগামী দুই-তিন পর এখানে এ রকম দেখবেন না।”
নতুন কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানতে তমা কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান ভূঁইয়ার (মানিক) মোবাইলে ফোন করে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
তবে সোমবার তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সব ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েই তারা কাজ করে আসছেন।
নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আতাউর তমা কনস্ট্রাকশনের মূল প্রতিষ্ঠান তমা গ্রুপেরও চেয়ারম্যান।
তবে ঠিকাদার ও তত্ত্বাবধায়ক প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার কারণে তিন দফায় সময় বাড়ানোর পর এখন ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা। মেয়াদ বাড়ার সমান্তরালে প্রকল্পের ব্যয়ও প্রায় ৫৮ শতাংশ বাড়িয়ে এক হাজার ২১৯ কোটি টাকায় উন্নীত করেছে সরকার।
ঢিমেতালের এই কাজে দীর্ঘদিন ধরে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে ঢাকার প্রাণকেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কে চলাচলকারীদের।