গাবতলীতে দফায় দফায় সংঘর্ষ, ভাংচুর-আগুন

ঢাকার গাবতলীতে গাড়ি ভাঙতে বাধা পেয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন ধর্মঘটে থাকা পরিবহন শ্রমিকরা।

লিটন হায়দারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Feb 2017, 03:32 PM
Updated : 28 Feb 2017, 08:47 PM

মঙ্গলবার রাত ৮টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কয়েক দফা সংঘর্ষে চার পুলিশসহ আটজন আহত হয়েছেন।

শ্রমিকদের গাড়ি ভাংচুর-অগ্নিসংযোগের জবাবে কাঁদুনে গ্যাসের শেল ছোড়ে পুলিশ। সংঘর্ষে বন্ধ হয়ে যায় রাজধানীতে ঢোকার এই পথ। গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কে কয়েক ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ থাকায় ওপাশে ঢাকামুখী কয়েকশ গাড়ি আটকা পড়ে। পরে আশুলিয়া ঘুরে পণ্যবাহী ট্রাকসহ অন্য গাড়ি ঢাকার দিকে আসায় যানজট তৈরি হয় বিমানবন্দর সড়কেও।

ধর্মঘট উপলক্ষে সকাল থেকেই গাবতলীতে আন্তঃজেলা শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। সন্ধ্যার পর তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।

এক পর্যায়ে শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে গাড়ি চলাচলে বাধা দেয়। কয়েকটি গাড়িতে ভাংচুর চালায় তারা। এ সময় পুলিশ তাদের থামানোর চেষ্টা করলে সংঘর্ষ শুরু হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।

স্বল্প সংখ্যক পুলিশ সদস্য তাৎক্ষণিকভাবে পিছু হটে। পরে অতিরিক্ত পুলিশ এলে উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদুনে গ্যাসের শেল ছোড়ে পুলিশ।

এরইমধ্যে আন্তঃজেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যালয়ের সামনে পুলিশের একটি রেকার এবং একটি অস্থায়ী পুলিশ বক্সে আগুন দেওয়া হয়।

ঘণ্টাখানেক পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার দাবি করেন দারুস সালাম থানার ওসি সেলিমুজ্জামান।

পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার মো. মাসুদুর রহমান সে সময় বলেন, “পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। শ্রমিকরা একদিকে অবস্থান করছে, বিপরীত দিকে পুলিশ অবস্থান রয়েছে। পরিস্থিতির অবনতি যাতে না হয় সে দিকে আমাদের নজর রয়েছে।”

তবে রাত সাড়ে ৯টায় গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের সামনে শ্রমিকরা আরেকটি মাইক্রোবাস ভাংচুর করে বলে ঘটনাস্থল থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কর্মী বেলাল হোসেন জানান।

এরপর উভয়পক্ষে বিক্ষিপ্তভাবে সংঘর্ষ চলতে থাকে। এরমধ্যে রাত সাড়ে ১১টার দিকে আহত তিন কনস্টেবল ও একজন পথচারীকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়।

আহত কনস্টেবল অনিক চক্রবর্তী (২২) সাংবাদিকদের বলেন, সামনে হঠাৎ একটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটলে তারা চারজন আহত হন।

তার সঙ্গে আহত অন্যরা হলেন- কনস্টেবল মিজু আহমেদ (২১) ও রবিউল ইসলাম (২১) এবং পথচারী রবিউল (৪০)।

সংঘর্ষে আরও একজন পুলিশ সদস্যসহ চারজনকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়।

তারা হলেন- কনস্টেবল রফিকুল ইসলাম (২২), গাড়িচালক মো. হাসান, গরু ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন ও হোটেল কর্মচারী রিফাত।

রফিকুলের বোমার স্প্লিন্টার এবং অন্যদের ছররা গুলি লেগেছে।

সংঘর্ষের মধ্যে রাত ১০টায় ঘটনাস্থলে গিয়ে শ্রমিকদের শান্ত করার চেষ্টা করেন স্থানীয় সাংসদ আসলামুল হক। গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকা ঘুরে এসেও শ্রমিকদের শান্ত করতে ব্যর্থ হন তিনি।

সহিংসতার জন্য বিএনপির দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে আসলামুল সাংবাদিকদের বলেন, “আমি নিজে একা গিয়েছিলাম শ্রমিকদের মাঝে। আমি ভেবেছিলাম শ্রমিক নেতৃবৃন্দকে পাব, সেখানে আমি আমার সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে কথা বলব। কিন্তু শ্রমিক নেতৃবৃন্দ কাউকে পাই নাই। যারা এখানে আছে সব কম বয়সী ছেলে-পেলে।

“আমার কাছে মনে হয়েছে যে, বিষয়টা অন্য কারোর হাতে চলে গেছে। আপনারা জানেন, আমাদের দেশে দীর্ঘদিন যাবৎ যে আগুন সন্ত্রাস চলছে, তাদের কোনো দুরভিসন্ধি আছে কি না, অনুপ্রবেশ করেছে কি না শ্রমিকদের এই হরতালে-আমরা সেই বিষয়টি দেখছি।”

আসলামুল হক শ্রমিক নেতাদের এই সহিংস বিক্ষোভ থেকে সরে আসার আহ্বান জানান। অন্যত্থায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মিলে ‘প্রতিকার’ করার ঘোষণা দেন তিনি।

“ভোর হওয়ার সাথে সাথে পরিষ্কার হয়ে যাবে,” বিক্ষোভরত শ্রমিকদের ইঙ্গিত করে বলেন মিরপুর এলাকার এই সাংসদ।

এরমধ্যে রাত সাড়ে ১১টার দিকে মাজার রোডের সামনে একটি ট্রাকে আগুন দেয় বিক্ষোভকারীরা। পরে তাদের পিছু হটায় পুলিশ। রাত ২টার সময়ও আমিনবাজার এলাকায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছিল শ্রমিকরা। এদিকে অবস্থান নিয়ে ছিল পুলিশ ও র্যােব সদস্যরা।

মধ্যরাতে মাজার রোড এলাকায় আওয়ামী লীগের শ’ দুয়েক নেতাকর্মীকে অবস্থান নিতে দেখা যায়।

প্রথম দফা সংঘর্ষের সময় শ্রমিকরা শুধু পুলিশের একটি রেকারে আগুন দেয় বলে দাবি করেন ওসি সেলিমুজ্জামান।

তবে আলম নামে একজন বাস শ্রমিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, শ্রমিকরা হানিফ পরিবহনের বালুর মাঠ কাউন্টারের সামনে একটি অস্থায়ী পুলিশ বক্সে আগুন দিলে তা পুড়ে যায়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক-পশ্চিম) লিটন কুমার দাস জানান, মেরামতের জন্য মিরপুরের একটি রেকার গাবতলীতে নেওয়া হয়েছিল। রাস্তার একপাশে চাকা খুলে কাজ চলছিল। ওই সময়ে বিক্ষুব্ধরা আগুন দেয়।

রেকারে আগুন দেওয়ার খবর শুনে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট যাত্রা করেও ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেনি বলে বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা পলাশ চন্দ্র মোদক জানান।

সড়কে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মৃত্যুর জন্য দায়ী বাসচালককে শাস্তি দিয়ে গত সপ্তাহে মানিকগঞ্জের আদালতে রায়ের পর শ্রমিক বিক্ষোভের শুরু।

বাসচালক জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার পর তার জেলা চুয়াডাঙ্গার পরিবহন শ্রমিকরা প্রথম ধর্মঘট শুরু করে। এরপর গত রোববার খুলনা অঞ্চলের ১০ জেলায় ধর্মঘট শুরু করেন পরিবহন শ্রমিকরা।

এর মধ্যেই সোমবার ঢাকার আদালতের এক রায়ে সাভারে সড়কে এক নারীর মৃত্যুর ঘটনায় এক ট্রাকচালককে মৃত্যুদণ্ড দিলে মঙ্গলবার থেকে সারাদেশে বাস চলাচল বন্ধ করে দেয় শ্রমিকরা।

এতে দিনভর ভোগান্তির পর রাতে গাবতলীতে এই সংঘর্ষে যানজট সৃষ্টি হয় বিমানবন্দর সড়কে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে মহাখালী থেকে উত্তরা যাওয়ার পথে দীর্ঘ যানজটে পড়েন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সুমন মাহবুব।

সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা পরিবহনের শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানান, গাবতলীতে যান চলাচল বন্ধ হওয়ায় পণ্যবাহী ট্রাকসহ অনেক গাড়ি আশুলিয়া হয়ে বিমানবন্দর সড়কে ঢোকে। এতে গাড়ির চাপে এই সড়কেও দেখা দেয় যানজট।