ধর্মঘটের কারণে মঙ্গলবার সকাল থেকে কোনো যাত্রী বা পণ্যবাহী যানবাহন ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছে না। একই চিত্র দেশের প্রতিটি জেলায়।
এমনকি শহরতলীর বিভিন্ন গন্তব্যের বাস চলাচলেও বাধা দিচ্ছেন রাজধানীর পরিবহন শ্রমিকরা। গাবতলীতে বাস থেকে যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়ারও অভিযোগ এসেছে সংবাদমাধ্যমে।
জরুরি প্রয়োজনে ঢাকার বাইরে যাওয়ার জন্য টার্মিনালে এসে গাড়ি না পেয়ে অসহায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যাত্রীরা। সারা দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরও সরকারের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ না দেখে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
নেত্রকোণা যাওয়ার জন্য মহাখালী টার্মিনালে এসে বাস না পেয়ে ফেরদৌস হাসান নামের এক যাত্রী বলেন, “দুর্ঘটনা ঘটলে যাত্রীরা মারা যায়। সেজন্য কোর্ট শাস্তি দিয়েছে বলে এরা (পরিবহন মালিক-শ্রমিক) মানুষকে জিম্মি করেছে। সাধারণ মানুষের ওপরই সব জুলুম।”
বীণা ভৌমিক নামের এক নারী তার এক আত্মীয়র মৃত্যুর খবর পেয়ে টাঙ্গাইলে যাওয়ার জন্য সকালে মহাখালী বাস টার্মিনালে আসেন। কিন্তু বিকাল ৩টায়ও বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করতে না পেরে পরিবারের তিন সদস্য নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি।
ক্ষুব্ধ বীণা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোনো ঘোষণা-আল্টিমেটাম ছাড়া এমন অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট তো কখনও দেখিনি।”
এভাবে যারা বিপদে পড়েছেন, তাদের জন্য সরকারিভাবে বিকল্প ব্যবস্থা করার দাবি জানান তিনি।
মঙ্গলবার বিকালেও মহাখালী বাস টার্মিনালে শত শত যাত্রীকে ব্যাগ-স্যুটকেস নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। একই পরিস্থিতি ঢাকার সায়েদবাদ, গাবতলী বাস টার্মিনালেও।
সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনায় এক বাস চালকের যাবজ্জীবন এবং এক ট্রাক চালকের ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে মঙ্গলবার সকাল থেকে সারা দেশে আকস্মিক এই ধর্মঘটের শুরু।
এস আলম পরিবহনের ঢাকা অঞ্চলের ইনচার্জ মোহাম্মদ মঞ্জুর মোরশেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরিবহন শ্রমিকরা ধর্মঘট ডেকেছে, সারাদেশে যান চলাচল বন্ধ। আমরা অসহায়ের মতো এর সঙ্গে আছি। পক্ষেও নাই বিপক্ষেও নাই।”
ইউনিক পরিবহনের মহাব্যবস্থাপক আবদুল হক বলেন, চালকরা ‘রাজি না হওয়ায়’ তাদের সব গাড়িই বন্ধ।
ঢাকার বাসাবো এলাকার বাসিন্দা সুমাইয়া আক্তার টাঙ্গাইলের বাস ধরতে চার বছরের ছেলে ফাহাদকে নিয়ে বিকালে মহাখালীতে আসেন। কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করেও গাড়ি না পেয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েন তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ধর্মঘট কি দুই দিন ধরে চলবে, নাকি আমরা স্টেশন ছাড়ার পর গাড়ি চলা শুরু হবে কিছু বুঝতে পারছি না। এখন বাসায় ফিরব, নাকি আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করব তাও বুঝতে পারছি না।”
ঢাকার কাছাকাছি জেলাগুলোর অনেক যাত্রীকে মহাখালীতে বাস না পেয়ে অটোরিকশায় করে তিনগুণ ভাড়া দিয়ে উত্তরা বা টঙ্গীর দিকে যেতে দেখা যায়। তাদের উদ্দেশ্য ভেঙে ভেঙে পৌঁছানো।
তবে সেখানেও যাত্রীদের ব্যাপক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বলে উত্তরাফেরত কয়েকজন অটোরিকশা চালক জানালেন।
টঙ্গী ব্রিজ এলাকা থেকে মহাখালীতে আসা অটোরিকশা চালক মেহেদী হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “টঙ্গী গেলেও লাভ নাই। ওইখানে শয়ে শয়ে মানুষ খাড়ায় আছে।”
দুপুরে সায়েদাবাদে গিয়ে বিভিন্ন রুটের বাস টার্মিনালের ভেতরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরাও সেখানে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। অনেকে বাসায় ফিরে গেলেও জরুরি প্রয়োজন থাকায় কেউ কেউ অন্য বাহনের আশায় অপেক্ষা করছেন।
সিলেটের পাথর ব্যবসায়ী মো. আলী নেওয়াজ সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে এসেছিলেন স্ত্রী আর ভাতিজিকে নিয়ে। ঢাকায় কোনো আত্মীয়র বাসা না থাকায় মঙ্গলবারই সিলেটে ফিরতে চাইছিলেন তিনি। কিন্তু কোনো লোকাল বাসও তিনি পাননি।
খুলনার হান্নান খান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছেলের চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরতে সকাল ৬টায় গাবতলীতে গিয়ে আটকা পড়েন; সঙ্গে তার স্ত্রী আর বাবা-মা।
দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও গাড়ি না পেয়ে বেলা ২টার দিকে ট্যাক্সি ভাড়া করে পাটুরিয়া ফেরিঘাটের দিকে রওনা হন তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে হান্নান বলেন, “১৭ দিন ছেলের চিকিৎসা শেষে এখন বাড়ি যাচ্ছি। ধর্মঘট না কর্মবিরতি কিসের কারণে যেন বাস যাচ্ছে না। হাসপাতালে থাকার সময় যেসব কাপড়চোপড় ছিল সেগুলোও সাথে আছে। সকাল থেকে কিভাবে যে সময় পার করছি, আপনাকে বোঝাতে পারব না।”
গাবতলীতে ফরিদপুর, পিরোজপুর, বরিশালসহ বিভিন্ন রুটে চলা গোল্ডেন লাইন পরিবহনের কাউন্টার মাস্টার শেখ আলমগীর হোসেন বলেন, ‘কোম্পানির অর্ডার’ আছে বাস বন্ধ রাখার। তাদের আড়াইশ গাড়িই বসা।
হানিফ পরিবহনের মহাব্যবস্থাক মো. মোশাররফ হোসেন বলেন, চালকদের কর্মবিরতির কারণে তারা বাস ছাড়তে পারছেন না।
তবে মহাখালী টার্মিনালে এক চালক দাবি করেন, আকস্মিকভাবে এই ধর্মঘট ডাকা হয়নি। সোমবার রাতে সরকারের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনায় সমঝোতার মধ্যেই আরেক চালকের ফাঁসির আদেশের খবর এলে মালিকদের সঙ্গে যৌথ সভা করে শ্রমিক নেতারা ধর্মঘট ডাকতে বাধ্য হন।