বাল্য বিবাহ বিল পাস

‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ বিয়ের বয়সসীমা শিথিল করে বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন পাস করেছে বাংলাদেশের আইনসভা।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Feb 2017, 12:26 PM
Updated : 7 March 2017, 12:32 PM

মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর দেশের নারী সংগঠনগুলোর পাশাপাশি হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিলটি পাস না করতে বাংলাদেশের আইনপ্রণেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছিল।

এই আপত্তির মধ্যেই সোমবার ‘বাল্য বিবাহ নিরোধ বিল-২০১৭’ সংসদে পাসের প্রস্তাব করেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। কণ্ঠভোটে এটি পাস হয়ে যায়।

তার আগে বিলের ওপর দেওয়া বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যদের জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানো ও সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলোচনা হলেও কণ্ঠভোটে তা বাতিল হয়ে যায়।

এই আইন পাস হওয়ায় মেয়ে ও ছেলেদের বিয়ের ন‌্যূনতম বয়স আগের মতো ১৮ ও ২১ বছর বহাল থাকলেও ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ তার কম বয়সেও বিয়ের সুযোগ তৈরি হল।

তবে বিশেষ প্রেক্ষাপট কী এবং কত কম বয়সে বিয়ে করা যাবে, তা আইনে স্পষ্ট করা হয়নি। মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর বলা হয়েছিল, এগুলো আদালত নির্ধারণ করবে।

আইন পাসের প্রক্রিয়ার সময় ওঠা প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী চুমকি বলেন, “বিশেষ বিধানের এই সুযোগ যে কেউ চাইলেই পাবে না।

“কোনো অনভিপ্রেত ঘটনার ক্ষেত্রে পিতামাতা বা বৈধ অভিভাবক এবং আদালতের সম্মতি লাগবে। আদালতের অনুমতি ছাড়া কেউ বিয়ে দিতে পারবে না।”

তবে পাস হওয়া বিলে ‘বিশেষ প্রেক্ষাপট’ বিধি দ্বারা নির্ধারিত রাখার কথা বলা হয়েছে, যা সংসদে উত্থাপিত খসড়ায় ছিল না।

সামাজিক ক্ষেত্রে নানা সূচকে অগ্রগতি হলেও বাংলাদেশ বাল্য বিয়ে রোধের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে।

ইউনিসেফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে বাল্য বিয়ের হার সবচেয়ে বেশি। ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বাংলাদেশের ৬৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়।

বয়স কমানোর বিধানের সুযোগে বাংলাদেশে বাল্য বিয়ে উৎসাহিত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে তা বাতিলের দাবি তুলেছিল দেশি-বিদেশি মানবাধিকার ও নারী সংগঠনগুলো।

তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বিরোধিতাকারীরা বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে ‘অজ্ঞান’। সমাজ বাস্তবতার কথা বিবেচনায় রেখেই এই আইন করা হচ্ছে।

তার যুক্তিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে মানবাধিকার সংগঠন এইচআরডব্লিউ বলেছিল, “এ থেকে মনে হচ্ছে, ধর্ষণের কারণে কোনো মেয়ে গর্ভবতী হলে তাকেও ওই আইন দেখিয়ে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়েতে বাধ্য করা হতে পারে।”

বিরোধিতাকারীদের অভিযোগ, বাল্য বিয়ের হার কম দেখাতেই এই আইন সংশোধন করছে সরকার।

আইনটি পাসের আগে সংসদে আলোচনায় বিশেষ প্রেক্ষাপটটি সুস্পষ্ট করতে সংশোধনী প্রস্তাব এনেছিলেন জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম।

তিনি বলেন, “বলা হচ্ছে, মানবিক কারণে এই বিশেষ বিধান রাখা হয়েছে। তবে এটা কোন কোন ক্ষেত্রে, তা সুস্পষ্ট থাকা দরকার। না হলে এটার অপব্যবহার হতে পারে।”

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “কোনো ব্যক্তি অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো কন্যাকে বিয়ে করতে চাইলেন, কিন্তু আইনে অনুমতি দেয় না। এক্ষেত্রে ওই লোকটি ফুসলিয়ে মেয়ের সাথে অবৈধ মেলামেলার মাধ্যমে তাকে গর্ভবতী করে ওই বিশেষ বিধানের সুযোগ নিতে পারবে।”

তবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “বর্তমান সরকার নারীবান্ধব সরকার। আমরা কন্যাদের সুরক্ষার জন্যই এই ধারা রেখেছি।”

ব্রিটিশ আমলে প্রণীত ‘চাইল্ড ম্যারেজ রেসট্রেইন্ট অ্যাক্ট-১৯২৯’ বাতিল করে নতুন আইন হল এটি।

মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর বিলটি সংসদে ওঠে গত বছরের ৮ ডিসেম্বর। তখন বিলটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।

সরকারের অনুমোদিত বিলে ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ শুধু মেয়েদের বয়সসীমা শিথিলের প্রস্তাব রাখা হয়েছিল।

সংসদীয় কমিটি পুরুষদেরও এ সুবিধার আওতায় আনার বিষয়টি যুক্ত করে।

জাতীয় সংসদের ফাইল ছবি

সংসদে উত্থাপিত বিলে বিশেষ বিধান সম্পর্কে বলা হয়েছিল, “এই আইনের অন্যান্য বিধানে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো নারীর সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশনাক্রমে এবং মাতা-পিতার সম্মতিক্রমে বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণক্রমে বিবাহ সম্পাদিত হইলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে না।”

এখানে সংসদীয় কমিটি ‘কোনো নারীর’ শব্দটি বাদ দিয়ে শুধু ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ এবং ‘মাতা-পিতা’র সঙ্গে ‘প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের’ সম্মতির শব্দটি যোগ করেছে।

বাল্য বিয়ের স্বীকৃতি দেওয়ার আইন বলে সমালোচনা উঠলেও বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কে প্রতিমন্ত্রী চুমকি বলেন, বাল্য বিয়ে ঠেকাতেই এই আইন করেছেন তারা।

২০১৪ সালে যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত গার্লস সামিটে প্রধানমন্ত্রী যে ঘোষণা দিয়ে এসেছেন, তা বাস্তবায়নে এই আইন কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করেন প্রতিমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচে বিয়ের হার শূন্যে, ১৫-১৮ বছর বয়সীদের বিয়ের হার এক-তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনার পর ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দেন।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আমাদের দেশের মানুষ বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে জানেন কিন্তু মানেন না। বাল্যবিবাহ বন্ধে সংসদে উত্থাপিত আইনের ভূমিকা অনস্বীকার্য।”

পাস হওয়া বিলে বলা হয়েছে, কোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক নারী বা পুরুষ বাল্য বিয়ে করলে তিনি সর্বোচ্চ এক মাসের কারাদণ্ড এবং পাঁচ হাজারের বদলে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

সংসদে উত্থাপিত বিলে ১৫ দিনের আটকাদেশ বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের সম্মুখীন হওয়ার বিধান প্রস্তাব করা হয়েছিল। সংসদীয় কমিটি দণ্ডের বিধান পরিবর্তনের সুপারিশ করে।