রেন্ট এ কারের দখলে মুক্তাঙ্গন, ‘অসহায়’ কর্তৃপক্ষ

ব্যস্ত সচিবালয়ের পাশ ঘেঁষে একচিলতে মুক্তাঙ্গনে এখন চলছে রেন্ট এ কারের রমরমা ব্যবসা।

কাজী নাফিয়া রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Feb 2017, 03:25 AM
Updated : 24 Feb 2017, 05:30 AM

একসময় কিছু সভা-সমাবেশ হলেও বেশ কয়েকবছর ধরে ঢাকার জিরো পয়েন্ট ও পুরানা পল্টন মোড়ের মাঝামাঝি এ পার্কটি বোঝাই হয়ে থাকে ছোট-বড় নানা ধরনের গাড়িতে। আছে মসজিদ, বেশ কয়েকটি দোকানও।

প্রশাসন আর ক্ষমতাসীনদের ‘ম্যানেজ’ করে নির্বিঘ্নে চলছে ‘ঢাকা মাইক্রোবাস-কার মালিক সমিতি’র এই দখলদারিত্ব। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষও অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে।  

তাদের ভাষ্য, পুলিশ আর স্থানীয় রাজনীতিবিদদের ‘মদদ’ থাকায় মাঝে মাঝে উচ্ছেদ করেও দখলমুক্ত করা যাচ্ছে না রাজধানীর কেন্দ্রে থাকা এ পার্ক। নগরবাসী শিগগিরই পার্কটি ব্যবহার করতে পারবে, এমন আশ্বাসও দিতে পারছেন না তারা।

সোমবার মুক্তাঙ্গনে গিয়ে দেখা মিলল অর্ধশতাধিক গাড়ি চালকের। রেন্ট-এ-কারের ব্যবসা নিয়ে আগ্রহ দেখালে আগ্রহী হয়ে কথা বললেন তাদের কয়েকজন।

জানালেন, প্রথমে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে সদস্য হতে হবে, এরপর মিলবে পার্কে ভাড়ায় গাড়ি রাখার অনুমতি। পরে মাসে মাসে দিতে হবে তিন হাজার টাকা।

টাকা কীসের জন্য জানতে চাইলে সমিতির সদস্য নাসির হোসেন বলেন, পুলিশ আর স্থানীয় নেতাদের ‘ম্যানেজ করতে’ ওই খরচ।

গাড়ি রাখার বিভিন্ন রশিদ দেখিয়ে তিনি বলেন, “সদস্য হলে পুলিশ বা কেউ ডিস্টার্ব করবে না। সব ম্যানেজ করা আছে। ম্যানেজ না করলে সরিয়ে দিবে। এইজন‌্য টাকাটা নেওয়া হয়।”

সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহের হোসেন খান-ই সবকিছু দেখভাল করেন বলে জানান নাসির।

চালক-মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মেহের স্থানীয় আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগের নেতা। তার ছেলে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইমাম হোসেন খান।

দেখা গেল, সমিতির উদ্যোগে পার্কের ভেতরে মসজিদ এবং ফুটপাত লাগোয়া কয়েকটি দোকানও তৈরি করা হয়েছে। পার্ক সংলগ্ন ফুটপাতে কেউ এলেই সমম্বরে চালকদের জিজ্ঞাসা- ‘গাড়ি লাগবে?’

বেশিরভাগ ফুটপাত ব্যবহারকারীই এমন প্রশ্নে বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকাচ্ছেন, তাতেও রাগ নেই চালকদের। ‘টার্গেট’ পরের জনকে।

গুলিস্তানের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মোস্তফা কামাল বলেন, “এই পথে নিয়মিত যাই। দেখলেই একদল চেঁচিয়ে ওঠে। মনে হয়, এদিকে যারা হাঁটে তারা সবাই গাড়ি ভাড়া নিতে আসে।”

ইকরাম হোসেন নামের আরেক পথচারী বলেন, “পার্ক তো নাইই, এখন ফুটপাতও নাই। ব্যস্ত সড়কে ফুটপাতেও যদি দোকান বসে, তাইলে হাঁটব কই? এমন জায়গাও বেদখল! সিটি করপোরেশনও কিছু করে না; কি অদ্ভুত!”

রাস্তা দখল করে রেন্ট এ কারের ব্যবসা চলছে রাস্তার অপর পাশেও, একেবারে সচিবালয়ের দেয়াল ঘেঁষে।

ঢাকা সিটি ক্যাব মালিক সমিতি এখানে তাদের সদস্যদের গাড়ি রাখে। সেগুলো ধোয়াও হয় সেখানে। ফলে যানজটপ্রবণ এ রাস্তায় ভোগান্তি আরও বেড়েছে বলে পথচারীদের দাবি।

সমিতির সদস্য শফিক হোসেন বলেন, মুক্তাঙ্গনের অংশের তুলনায় তাদের এই অংশ ‘চাঁদার হার কম’। আগে ২০ হাজার টাকা দিয়ে সদস্য হতে হত, এখন ১০ হাজার টাকা লাগে।

“এখানে কোনো সমস্যা হলে আমরা দেখি। আর গাড়ি রাখতে প্রতি মাসে দেড় হাজার টাকা দিতে হবে। চাঁদার টাকা কাজেই ব্যয় হয়। শাহবাগ থানা, সচিবালয় পুলিশ সবাইকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ রাখতে হয়,” বলেন তিনি।

রাস্তায় গাড়ি রেখে ব্যবসা করতে কোনো সমস‌্যা হয় কি না- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “সব তো ম্যানেজ। কখনো অভিযান বা ঝামেলা হলে আগেই আমরা টের পেয়ে যাই। তখন গাড়ি সরিয়ে নেই।”

রাস্তার ওপারের তুলনায় এখানে চাঁদা কম হওয়ার কারণ জানতে চাইলে শফিক বলেন, “আমরা খন্দকার এনায়েত উল্লাহ নেতৃত্বাধীন ঢাকা সড়ক পরিবহন শ্রমিক সমিতির একটি সংগঠন। এখানে যাত্রী ছাউনিতে আমাদের অফিস আছে, এ রাস্তায় চারটি গাড়ি রাখার বৈধতাও আছে আমাদের। কিন্তু মুক্তাঙ্গনের ওদের কোনো বৈধতা নাই, অফিসও নাই; তাই ম্যানেজ করতে ওদের বেশি চাঁদা লাগে।”

তবে ঢাকা মাইক্রোবাস-কার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহের হোসেন খান ‘ম্যানেজ’ করে মুক্তাঙ্গনে ব্যবসা করার কথা অস্বীকার করেছেন। তার ভাষ‌্য, আগে পুলিশকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করা লাগত, এখন আর ‘সে সমস্যা নেই’।

এজন্য নিজের বা ছেলের রাজনৈতিক ‘প্রভাব’ কাজে লাগানোর অভিযোগও অস্বীকার করেছেন মৎস্যজীবী লীগের এই স্থানীয় নেতা।

“এখন বয়স হয়ে গেছে। ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত আছি। ওখানে গাড়ি আছে, যাওয়া আসা করি, তাই সমিতির সদস্যরা ভালবেসে সাধারণ সম্পাদক বানিয়েছে। আর গুলিস্তানে ছেলের আলাদা এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যবসা আছে। এখানকার ব্যবসার সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।”

সমিতির সদস্য হতে ২৫ হাজার টাকা নেওয়ার কথাও ‘ঠিক নয়’ বলে মেহেরের দাবি। অবশ‌্য ‘অন্যান্য ব্যবস্থাপনা’র জন্য মাসে ‘কিছু টাকা’ নেওয়ার কথা তিনি স্বীকার করেছেন।

এভাবে গাড়ি রেখে ব‌্যবসা করার বৈধতা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন সমিতির সদস্যদের পুনর্বাসন করলেই তারা মুক্তাঙ্গন থেকে সরে যাবেন। এ নিয়ে আলোচনাও হচ্ছে।

তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মুহাম্মদ বেলাল বলছেন, ‘অবৈধ ব্যবসায়ীদের’ সঙ্গে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই।

“এটা সম্পূর্ণ অবৈধ। এর কোনো বৈধতা নেই। এই পার্ককে বলা যায় হার্ট অব দি ঢাকা। এমন একটা সেন্টার পয়েন্টে এসব রেন্ট এ কারের ব্যবসা হতে পারে না। এখানে গাড়ি রাখা ঠিক না। শুধু গাড়ি পার্কিং না, আরও নানা রকম স্থাপনা গড়ে উঠছে; সব অবৈধ।”

সিটি করপোরেশন এসব অবৈধ কাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন জানতে চাইলে বেলাল বলেন, বিভিন্ন সময় চেষ্টা করা হলেও তুলে দেওয়া যাচ্ছে না।

“আর আমাদের তো একটা কাজ না। অনেক কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়।”

প্রভাবশালীদের কারণে এদের উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি।

“আপনি সেখানে যান, গেলেই সব বুঝে যাবেন। তারাই বলবে,” বলেন সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী।

অর্থের বিনিময়ে মুক্তাঙ্গন ও সচিবালয়ের পাশের রাস্তায় গাড়ি রাখতে দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন পল্টন থানার ওসি রফিকুল ইসলাম। তার দাবি, কোনো রকম চাঁদাবাজির সঙ্গে পুলিশের সংশ্লিষ্টতা নেই।

“এ অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। পরিবহনের লোকজন আছে, তাদের সমিতি আছে, এর মাধ্যমে হয়তো তারা
কাজটি করে। কিন্তু এর সাথে আমাদের কারও যোগাযোগ নেই।"