শেষভাগে জমজমাট বইমেলা

মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলার শেষভাগে এসে আরও জমে উঠেছে লেখক-প্রকাশক ও পাঠকের মিলনমেলা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Feb 2017, 03:07 PM
Updated : 23 Feb 2017, 03:07 PM

বৃহস্পতিবার ভোররাতে ঢাকায় হয়েছে ফাল্গুনের বৃষ্টি। মেলাপ্রাঙ্গনে জমেছিল পানি, কোথাও থকথকে কাদা। তবুও কমেনি বইপ্রেমীদের ভিড়। মেলার দুয়ার খোলার অনেক আগেই বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকে দেখা যায় দীর্ঘ লাইন।

মেলায় চলছে বই বেচাকেনার উৎসব। কোন বইগুলো সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষের হিসাব পাওয়া না গেলেও স্টলকর্মীদের কথায় উঠে এসেছে ক্রেতাদের আগ্রহে থাকা বইগুলোর নাম।

এবারের মেলায় প্রথম দিনই তাম্রলিপি থেকে প্রকাশিত হয়েছে মুহম্মদ জাফর ইকবালের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ‘রিটিন’। এখন পর্যন্ত মেলার সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বইগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। একই প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হুমায়ূন আহমেদের মা আয়েশা ফয়েজের লেখা ‘শেষ চিঠি’ ও ইয়াসমীন হকের লেখা ‘সাস্টের ২২ বছর’ বই দুটিও বেশি বিক্রি হওয়া বইয়ের তালিকায় রয়েছে।

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে ‘ইংরেজি থেকে বাংলা অভিধান’ ও ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’ বিক্রি হচ্ছে অনেক। আগামী থেকে প্রকাশিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’ আছে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বইগুলোর মধ্যে।

অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হুমায়ূন আহমেদের ‘মিসির আলী দশ’ সংকলনটি আছে বেশি বিক্রিত বইয়ের তালিকায়। একই প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত প্রয়াত এই কথা সাহিত্যিকের ‘দেয়াল’ ও ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ এখনও অনেক বিক্রি হওয়ার কথা বলেছেন স্টলকর্মীরা। অনন্যা থেকে প্রকাশিত ইমদাদুল হক মিলনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘নয়মাস’র কাটতিও বেশ।

অবসর থেকে প্রকাশিত হরিশংকর জলদাসের উপন্যাস ‘অর্ক’ এবং রকিব হাসানের ‘ভ্যাম্পায়র’র বিক্রিও বেশ। শব্দশৈলী থেকে প্রকাশিত ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহগের লেখা ‘ছাত্রলীগের ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাস’ বইটি বেশ চলছে। ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত বুলবুল সরওয়ারের ‘স্বপ্নভ্রমণ জেরুসালেম’ বইটিও বেশ বিক্রি হচ্ছে বলে স্টলকর্মীরা জানিয়েছেন।

বাংলা একাডেমির ‘গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার’ ঘোষণা

মেলার ২৩তম দিনে বাংলা একাডেমি তাদের ‘গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার’ ঘোষণা করেছে।

অমর একুশে উদযাপনের অংশ হিসেবে ২০১৬ সালে প্রকাশিত বিষয় ও গুণমানসম্মত সর্বাধিক সংখ্যক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য জার্নিম্যান বুকসকে ‘চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার-২০১৭’ দেওয়া হচ্ছে।

২০১৬ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে গুণমান ও শৈল্পিক বিচারে ‘সেরা’ গ্রন্থের জন্য রফিকুন নবীর ‘দেশসেরা জগৎসেরা শিল্পীকথা’ বইটির জন্য প্রথমা প্রকাশন, পাভেল রহমানের ‘সাংবাদিকতা আমার ক্যামেরায়’ বইয়ের জন্য মাওলা ব্রাদার্স, রনজিত কুমার মণ্ডলের ‘আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়’ বইয়ের জন্য পুঁথিনিলয়কে ‘মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে।

২০১৬ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণমান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য ‘চন্দ্রাবতী একাডেমি’ পাচ্ছে ‘রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার’।

২০১৭ সালের বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাতিঘর, সংবেদ ও পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেডকে ‘শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার’ দেওয়া হচ্ছে ।

২৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে  ৬টায় গ্রন্থমেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে এসব পুরস্কার দেওয়া হবে।

আয়েশা ফয়েজ সাহিত্য পুরস্কার

এ বছর আয়েশা ফয়েজ সাহিত্য পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন শ্বেতা শতাব্দী এষ ও মধুমিতা চক্রবর্তী। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মায়ের নামে ২০১৬ সালে এই পুরস্কার প্রবর্তন করে তাম্রলিপি প্রকাশনা  মার্চ মাসের যে কোনো সময় আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কারপ্রাপ্তদের হাতে পুরস্কারের অর্থ ও পদক তুলে দেওয়া হবে।

নতুন বই

বইমেলার ২৩তম দিনে নতুন বই এসেছে ৭২টি এবং ৩১টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। এরমধ্যে একুশে বাংলা এনেছে অনু হোসেনের ‘টুনটুনির গল্প’, ম্যাগনাম ওপাস এনেছে ড. শেখ আবুল কালামের ‘প্রকাশিত অপ্রকাশিত কবিতা’, তৌফিক রহমানের ‘আলো আঁধারে বাংলাদেশের পর্যটন’, শামীম পাবলিকেশন্স এনেছে রকিব হাসানের ‘সেরা দুই কিশোর গোয়েন্দা কাহিনী’, ঐতিহ্য এনেছে অনু হোসেনের ‘বোধ ও বাতি’, জয়তী এনেছে আশরাফুল হাসান বিপ্লবের ‘মিথ্যা কথা বলছি না’, মাওলা ব্রাদার্স এনেছে আবদুস সামাদ ফারুকের ‘আলো হাতে আঁধারের যাত্রী’, নবযুগ এনেছে সন্জীদা খাতুনের ‘সংস্কৃতির বৃক্ষ ছায়ায়’, আহম্মদ পাবলিকেশন্স এনেছে ‘সর্দার জয়নুল আবেদীনের ‘হিটলু’, শিলা প্রকাশনী এনেছে উম্মে হাবীবাহর ‘ফেরারী সন্ধ্যা’, কথা প্রকাশ এনেছে আবুল ফজলের ‘শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ’, সৈয়দ আজিজুল হকের ‘বাংলা কথাসাহিত্যে মানবভাবনা’, সময় প্রকাশন এনেছে শামসুজ্জামান খানের ‘দূরে দূরান্তর’, ধ্রুব এষের ‘মাত্রা’, প্রান্ত প্রকাশন এনেছে মোহাম্মদ মামুন চৌধুরীর ‘সাংবাদিকতার এপিঠ ওপিঠ’, মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর ‘শিক্ষকতায় সৃজনশীলতা’, আদর্শ এনেছে দেলোয়ার হোসেনের ‘বাংলাদেশের বীরগাঁথা’, জোনাকী এনেছে জয়ীতা শিল্পীর ‘রাজারবাগে প্রজার পুলিশ’।

পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স প্রকাশ করেছে তরুণ কবি ও কথাসাহিত্যিক নওশাদ জামিলের ভ্রমণগ্রন্থ ‘লঙ্কাপুরীর দিনরাত্রি’। শ্রীলঙ্কার ইতিহাস, ঐতিহ্য, পুরাকীর্তি, গ্যালারিসহ নানা নিদর্শন বইতে শৈল্পিকভাবে তুলে ধরেছেন লেখক। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শিবু কুমার শীল।

বৃহস্পতিবার বইমেলায় সূচিপত্র প্রকাশনী থেকে প্রকাশ হয়েছে শ ম রেজাউল করিমের লেখা ‘শীর্ষ মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসির রায়: ইতিহাসের দায়মুক্তি’ বইটি। মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অংশে মোড়ক উন্মোচন মঞ্চে বইটির মোড়ক করেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম।

‘স্পর্শ ব্রেইল’ এনেছে আটটি নতুন বই

এদিন স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে আটটি নতুন বই। বইগুলোর মধ্যে রয়েছে মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘দলের নাম ব্ল্যাক ড্রাগন’, ‘ঈশপের গল্প’, জুলভার্নের ‘৮০ দিনে বিশ্বভ্রমণ’, সৈয়দ নজিমউদ্দিন হাশেমের ‘গলদা দাদার গোয়েন্দাগিরি’, নারীপক্ষের ‘ব্রেস্ট ক্যান্সার’, কবিতা সংকলন ‘স্পর্শ ছুরি’, লুৎফুর রহমান রিটনের ‘রসগোল্লাটা কথা বলে’, কাইজার চৌধুরীর ‘শোভনের ৭১’। এছাড়াও একই দিন প্রকাশিত হয়েছে আইরিন সুলতানার সম্পাদনায় অডিও সিডি ‘৭১ দেখব বলে’।

বৃহস্পতিবার বিকালে বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান মিলনায়তনে এই বইগুলোর মোড়ক উন্মোচন হয়।

প্রধান অতিথি শামসুজ্জামান খান বলেন, “আমরা ওয়াদা করছি, এখন থেকে ওদের আর আমরা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বলব না, ওদের আমরা দৃষ্টিজয়ী বলব। আগামী বইমেলা থেকে বাংলা একাডেমি থেকে দুটো বই আমরা ব্রেইলে প্রকাশ করব। এছাড়া দৃষ্টিজয়ী শিশুদের পারফরম্যান্স থাকবে আগামী বইমেলার উদ্বোধনীতে।”

‘দৃষ্টিজয়ী’ শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবে বলে আশা প্রকাশ করেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

তিনি বলেন, “এদের করুণা নয়, এদের সুযোগ করে দিতে হবে। এই শিশুরা একদিন বড় বিজ্ঞানী হবে, এরাই বাংলাদেশ নির্মাণ করবে।”

মূল মঞ্চের অনুষ্ঠান

বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘অনুবাদ সাহিত্য: সাহিত্যের অনুবাদ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান।

প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক আবদুস সেলিম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কবি ড. মুহাম্মদ সামাদ, কবি শামীম আজাদ ও সাদাফ সায।  সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস।

অধ্যাপক আবদুস সেলিম বলেন, “আমাদের দেশে এখন অনুবাদকর্মে অনেকেই উদ্যোগী হয়েছেন। তার অর্থ এই নয় যে, প্রয়োজন অনুযায়ী যথেষ্ট অনুবাদকর্ম হচ্ছে। এর প্রধান কারণ প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের অভাব এবং অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতা।”

অধ্যাপক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস বলেন, “সাহিত্যের অনুবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং একই সঙ্গে জটিল প্রপঞ্চ। সাহিত্যমান অক্ষুণœ রেখে বিষয়ানুগ থাকা অনুবাদকের পক্ষে সহজ কাজ নয়।

“এ বিষয়ে যেমন ভাষাজ্ঞানের যথার্থতা প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন জ্ঞানকাণ্ডের বিভিন্ন শাখা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা।”