‘এ দিন আমার ভায়েরা আমায় বেঁধেছে রক্তঋণে’

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকের বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে যারা জীবন উৎসর্গ করেছিল, যাদের আত্মত্যাগে বাঙালি পেয়েছিল ভাষার অধিকার, ফুল আর শ্রদ্ধায় তাদের স্মরণ করেছে জাতি।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Feb 2017, 03:30 AM
Updated : 21 Feb 2017, 01:28 PM

পোশাকে শোকের কালো; শহীদের বুকের খুনে রাঙা ফুল হাতে, হাতে। শ্রদ্ধায় নাঙ্গা পায়ে প্রতিটি পদক্ষেপে ভাষার অহঙ্কার। একুশ আলোর ভোরে সব পথ যেন মিশে শহীদ মিনারে।

প্রভাতফেরির পথে পথে কণ্ঠে কণ্ঠে সেই গান-  আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি… আমি কি ভুলিতে পারি…।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মিছিলে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নির্দেশে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান সালাম, রফিক, বরকত, শফিউরসহ নাম না জানা অনেকে।

এরপর বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয় তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালির এই আত্মত্যাগের দিনটি এখন আর বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়; ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে সারা বিশ্বে।

বাঙালির ভাষার সংগ্রামের একুশ এখন বিশ্বের সব ভাষাভাষীর অধিকার রক্ষার দিন। ইউনেস্কো এবারের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতিপাদ‌্য ঠিক করেছে ‘বহুভাষায় শিক্ষা’।

মঙ্গলবার গর্ব আর শোকের এই দিনটি নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করছে জাতি, যার সূচনা হয় একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে।

একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এরপর শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে শহীদ বেদীতে ফুল দেন। তারপর ফুল দেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ।

ঢাকার দুই মেয়র, তিন বাহিনীর প্রধান, পুলিশ প্রধান, কূটনীতিকদের পর ফুল দেয় ক্ষমতাসীন ১৪ দল। সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, অ‌্যাটর্নি জেনারেলও ফুল দেন প্রথম প্রহরে।

হুইল চেয়ারে বসে একদল যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান ভাষাশহীদদের।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ছাড়ার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফুল দেন শহীদ বেদীতে।

কড়া নিরাপত্তার মধ‌্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর শহীদ মিনার সবার জন্য খুলে দেওয়া হয়।

এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, ফায়ার ব্রিগেড ও সিভিল ডিফেন্স, জাসদ ছাত্রলীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি শহীদ বেদীতে ফুল দেয়।

রাত ১টা ২৭ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ মানুষের মিছিল কিছুক্ষণের জন্য থামিয়ে তাকে ফুল দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়।

কালো ব্যাজ বুকে নিয়ে খালেদা জিয়া তার দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিয়ে ফুল দিয়ে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন।

সিইসি কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বে নতুন নির্বাচন কমিশনের সদস‌্যরা ভোর সাড়ে ৫টার দিকে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণের এই পালায় রোববার সকালে নামে মানুষের ঢল। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে আসা সর্বস্তরের মানুষে সারি আরো দীর্ঘ হয়। দীর্ঘ লাইনে ফুল আর ছোট ছোট পতাকা হাতে লাইন বেঁধে অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায় সব বয়সের, সব শ্রেণি পেশার মানুষকে।

বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তাদের সন্তানদের নিয়ে শহীদ মিনারে যান ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরসহ বিদেশে বাংলাদেশের সব মিশনেই বিষয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। প্রবাসীরাও বিদেশের মাটিতে শহীদ মিনার গড়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন ভাষার জন্য শহীদদের।   

ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রামসহ সারা দেশে প্রথম প্রহরেই শহীদ মিনারে শুরু হয় শ্রদ্ধা জানানোর পালা।  ফুলে ফুলে ভরে ওঠে প্রতিটি মিনার।

২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সাধারণ ছুটির দিন। ভাষা শহীদদের স্মরণে এদিন জাতীয় পতাকা ছিল অর্ধনমিত।

আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা কবিতায় আলতাফ মাহমুদের সুরে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি আজ প্রভাতফেরির প্রাণ। এ গানে প্রথমে সুর দিয়েছিলেন গীতিকার-সুরকার আবদুল লতিফ। একুশ নিয়ে লতিফ লিখে গেছেন- ‘আবার এসেছে অমর একুশে, পলাশ ফোটানো দিনে, এ দিন আমার ভায়েরা আমায় বেঁধেছে রক্তঋণে’।