‘আমি কি ভুলিতে পারি’

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকের গুলির সামনে দাঁড়িয়ে যারা উৎসর্গ করেছেন নিজেদের, যাদের জীবনের দামে পেতে হয়েছে বাংলাকে; ফুলেল শ্রদ্ধায় তাদের স্মরণ করছে বাংলাদেশ।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Feb 2017, 06:12 PM
Updated : 20 Feb 2017, 08:32 PM

মঙ্গলবার প্রথম প্রহরে ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ফুল দেওয়ার মধ‌্য দিয়ে ভাষাশহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানের সূচনা হয়।

রাত ১২টা ১ মিনিটে রাষ্ট্রপ্রধান মো. আবদুল হামিদ প্রথমে ফুল দেন শহীদ বেদীতে, এরপর দেন সরকার প্রধান শেখ হাসিনা। তারা ফুল দিয়ে কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন।

এরপর শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে শহীদ বেদীতে ফুল দেন। তারপর ফুল দেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ।

ঢাকার দুই মেয়র, তিন বাহিনীর প্রধান, পুলিশ প্রধান, কূটনীতিকদের পর ফুল দেয় ক্ষমতাসীন ১৪ দল। সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, অ‌্যাটর্নি জেনারেলও ফুল দেন প্রথম প্রহরে।

হুইল চেয়ারে বসে একদল যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান ভাষাশহীদদের।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ছাড়ার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফুল দেন শহীদ বেদীতে।

কড়া নিরাপত্তার মধ‌্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর শহীদ মিনার সবার জন্য খুলে দেওয়া হয়।

এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, ফায়ার ব্রিগেড ও সিভিল ডিফেন্স, জাসদ ছাত্রলীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি শহীদ বেদীতে ফুল দেয়।

রাত ১টা ২৭ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ মানুষের মিছিল কিছুক্ষণের জন্য থামিয়ে তাকে ফুল দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়।

কালো ব্যাজ বুকে নিয়ে খালেদা জিয়া তার দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিয়ে ফুল দিয়ে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মতো সারাদেশে থাকা শহীদ মিনারগুলো রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে ফুলে ফুলে ভরে উঠছে। আর শহীদ মিনারমুখী মিছিলের সবার কণ্ঠে অমর সেই গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি..।’

প্রথম প্রহরে জেগে থাকা শহীদ মিনার স্মরণ করছে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউরদের; ১৯৫২ সালে যাদের আত্মত‌্যাগের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায় বাংলা।

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নেতাকর্মীদের নিয়ে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালির এই আত্মত্যাগের দিনটি এখন আর বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়; ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে সারা বিশ্বে। বাঙালির ভাষার সংগ্রামের একুশ এখন বিশ্বের সব ভাষাভাষীর অধিকার রক্ষার দিন।

একুশে ফেব্রুয়ারির বাণীতে তার প্রতি আলোকপাত করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।

“অমর একুশের চেতনা আজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে। আমাদের শহীদ দিবস এখন বিশ্বজুড়ে নিজস্ব ভাষা ও স্বকীয়তা রক্ষার চেতনার অবিরাম উৎস।”

বাহান্নোর ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধিকার আন্দোলন হয়ে স্বাধীনতার পথ খুঁজে পাওয়ার কথাও বাণীতে বলেন আবদুল হামিদ।

বাণীতে একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের উন্নয়নে কাজ করতে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “অমর একুশে আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক।”

একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি আনতে যারা উদ‌্যোগী হয়েছিলেন, তাদেরও স্মরণ করেন শেখ হাসিনা।

অন‌্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিবৃতিতে একুশের চেতনায় ‘হারানো গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনার’ আহ্বান জানানো হয়েছে।

শহীদ মিনারে খালেদা জিয়া

“এখন মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে আবারও একদলীয় দুঃশাসনের শৃঙ্খলে দেশের মানুষকে আটকে রাখা হয়েছে। এভাবেই আজ একুশের স্বপ্নকে তমসাচ্ছন্ন করা হয়েছে।”

ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন অবসানের পর ভারতকে মাঝে রেখে পূর্ব ও পশ্চিমে দুটি অংশ নিয়ে পাকিস্তান নামে যে রাষ্ট্রটি গঠিত হয়েছিল, তাতে শুরুতেই নিপীড়ণের শিকার হল বাঙালিরা।

বঞ্চনার শিকার হয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মিছিলে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নির্দেশে পুলিশের গুলি চলে, প্রাণ হারান অনেকে।

আন্দোলনের মুখে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয় তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। এই একুশের চেতনায় শানিত হয়ে পাকিস্তান থেকে আলদা রাষ্ট্র হয়ে একাত্তরে আত্মপ্রকাশ ঘটে বাংলাদেশের।

একুশে ফেব্রুয়ারি দেশে সাধারণ ছুটির দিন। ভাষা শহীদদের স্মরণে এদিন জাতীয় পতাকা থাকবে অর্ধনমিত।