গণজাগরণ মঞ্চের চতুর্থ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রোববার বিকালে রাজধানীর শাহবাগে আলোচনা সভায় তিনি বলেন, “হেফাজতকে যদি আমরা প্রশ্রয় দিই, তাদের কথায় পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন মেনে নিই, তাহলে আমাদের মুক্তিবুদ্ধি চর্চার যে বাংলাদেশ এবং বাহাত্তরের সংবিধানের বাংলাদেশকে রাখতে পারব না। এটি শীঘ্রই পাকিস্তানের আদর্শে একটি সাম্প্রদায়িক দেশ হবে, প্রধানমন্ত্রী আপনাকে তারা হিজাব পরিয়ে ছাড়বে।
“মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার প্রতি আমাদের আবদার, আপনি এবং আপনার দল যারা ধর্মনিরপেক্ষ দল বলে গর্ব করে. আওয়ামী লীগ এখন হেফাজতের বিরুদ্ধে মাঠে নামুন।”
‘সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন, উগ্র মৌলবাদ, ৭২’র সংবিধান, কোন পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামে এই আলোচনার আয়োজন করে যুদ্ধাপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ২০১৩ সালে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চ।
“আমাদের গোয়েন্দা বাহিনী হত্যাকারীদের ধরতে পারেনি। আমাদের সরকার কি এতোই দুর্বল?” প্রশ্ন রাখেন তিনি।
২০১৪ সালে বইমেলা চলাকালে টিএসসি এলাকায় কুপিয়ে হত্যার করা হয় অজয় রায়ের ছেলে লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়কে। এরপর ধারাবাহিকভাবে ব্লগার, অনলাইন অ্যা ক্টিভিস্ট, প্রকাশক ও অন্যালন্যে ধর্মীয় গুরুদের ওপর হামলা হয়।
অজয় রায় বলেন, “অল্প কিছুদিনের মধ্যে ১০-১২ জন পুরোহিতকে হত্যা করা হয়েছে, মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে। শিয়া ও আহমদিয়া সম্প্রদায়ের উপর আঘাত করা হয়েছে। ব্লগারদের একের পর এক হত্যা করেছে মৌলবাদীরা। আমরা জানি না, এই হত্যার বিচারের জন্য আমাদের আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে! খুব অসহায় লাগে এখন।”
সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন চালিয়ে আসা সম্প্রীতি মঞ্চের সভাপতি অজয় রায়, “বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। পাঠ্যপুস্তকে যেন অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শ বজায় থাকে, সেদিকে লক্ষ রাখার দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। অথচ শিক্ষামন্ত্রী কিংবা অন্য কেউ এখন পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক সাম্প্রদায়িকীকরণের দায় স্বীকার করেননি।
“পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকীকরণের সঙ্গে যারা জড়িত তারা এনসিটিবির সদস্যই হোক বা হেফাজতের সদস্যই হোক তাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় সোপর্দ করতে হবে। যতদিন না আমরা সেটা করব ততদিন বাংলাদেশ উল্টো পথে চলতেই থাকবে।”
বাংলাদেশ এখন উল্টোপথে চলছে মন্তব্যয করে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, “আজ মুক্তিযুদ্ধের ৪৫ বছর পর সারাদেশে যা হচ্ছে, অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে উল্টোপথে বাংলাদেশ চলছে, তেমনটি কি কথা ছিল? সর্বগ্রাসী সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন থেকে এমনকি কোমলমতি শিশুদের মানসকাঠামোও রেহাই পাচ্ছে না। আমরা দেখছি, ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলো সামগ্রিক শিক্ষাকাঠামো নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা ঠিক করে দিচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কী পড়বে, কী পড়বে না!”
হেফাজতে ইসলামের দাবি সরকার ‘একদম অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশকে একটি অন্ধকার জনপদে পরিণত করার এই দাবিগুলো কোন সরকার বাস্তবায়ন করছে? মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলা- প্রগতিশীলতার কথা বলা সরকার, কয়েকটি বাম রাজনৈতিক দলও যে সরকারের অংশীদার! ”
ইমরান বলেন, “এই সরকার সমাজ, রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈপরীত্য তৈরি করে এর সুযোগ নিচ্ছেন। একদিকে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে মাদ্রাসায় পরিণত করা হচ্ছে, অন্যদিকে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় যারা পড়ালেখা করছে তাদের জীবনমান উন্নয়নের কোনো চেষ্টা করছেন না। তারা মুখে জঙ্গিবাদ দমনের কথা বলছেন, কিন্তু সারা দেশকে জঙ্গি উৎপাদনের উর্বরভূমিতে পরিণত করছেন। কাজেই আমাদের মনে প্রশ্ন থেকে যায়, তারা আসলে অন্তর থেকে কোন বাংলাদেশ চান?”
মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ জনগণের কাছ থেকে ‘লুট হয়ে গেছে’ মন্তব্যক করে তিনি বলেন, “আমরা ৪৫ বছর পরে এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারছি, কিন্তু আমরা জানি না এই বিচার চাইতে গিয়ে গত চার বছরে আমাদের যে সহযোদ্ধাদের হারিয়েছি আর কত বছর অপেক্ষা করতে হবে এই সব হত্যাকাণ্ডের বিচার পেতে।”
“তবুও দায়িত্ব সরকারকে নিতেই হবে। কিন্তু সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে হেফাজতকে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ করে দিচ্ছে।”
গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক মারুফ রসুলের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ডা. মোশতাক হোসেন, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক ইমরান হাবিব রুম্মন, ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জিলানী শুভ বক্তব্য দেন।
গণজাগরণ দিবসের নানা কর্মসূচি
চতুর্থ বর্ষপূর্তিতে ‘গণজাগরণ দিবসে’ শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে আলোচনা সভা ছাড়াও ছিল উৎসবমুখর নানা আয়োজন।
দুপুর ২টা থেকে শিশু কিশোরদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে শুরু হয় গণজাগরণের মিলনমেলা।
জাগরণযাত্রাটি শাহবাগ মোড় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ঘুরে আবার শাহবাগে ফিরে আসে।
গণজাগরণ দিবসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তনীতে শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয়।
আলোচনা সভা শেষে হয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।