ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার ভোর রাত ৪টা ১০ মিনিটে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে হাসপাতালের চিফ অপারেটিং অফিসার আল ইমরান জানান।
সুরঞ্জিত রক্তে হিমোগ্লোবিন স্বল্পতাজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর।
গত বছর মে মাসে শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন সুরঞ্জিত। পরে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালেও চিকিৎসা নেন তিনি।
শুক্রবার অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ল্যাবএইডে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে শনিবার রাত ৮টার দিকে তাকে নেওয়া হয় হাসপাতালের সিসিইউতে; পরে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়।
অবস্থার উন্নতি দেখা গেলে সকালে তাকে দেশের বাইরে নেওয়া যায় কি না সে কথা ভাবছিলেন পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু সব আশা শেষ হয়ে যাওয়ায় ভোরে তার লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলা হয়।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সকালে হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, “তিনি আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব। পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে তিনি নাম্বার ওয়ান বলে আমার মনে হয়। তার মৃত্যুতে বিরাট শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এটা সহজে পূরণ হবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই।”
ষাটের দশকের উত্তাল রাজনীতি থেকে উঠে আসা সাবেক এই বামপন্থি নেতা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন।
স্বাধীনতার পর থেকে অধিকাংশ সংসদে প্রতিনিধিত্ব করলেও সুরঞ্জিত প্রথমবার মন্ত্রী হন ২০১১ সালে। তবে তার স্বল্পমেয়াদের সেই মন্ত্রিত্বের অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি।
তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সকালে হাসপাতালে ভিড় করেন আত্মীয় স্বজনসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
সকাল ৯টার দিকে হাসপাতাল থেকে সাবেক এই মন্ত্রীর মরদেহ তার জিগাতলার বাসায় নেওয়া হলে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি, চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, স্থানীয় সাংসদ ফজলে নূর তাপস, আওয়ামী লীগ নেতা হাসান মাহমুদ, খালিদ মাহমুদ চৌধুরীসহ নেতাকর্মীরা জড়ো হন সেখানে।
রাশেদ খান মেনন বলেন, “সংবিধান প্রণয়নে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বে কেউ যদি আঘাত করার চেষ্টা করত, তাহলে উনি মন্ত্রী থাকা অবস্থাতেও তার প্রতিবাদ করতেন।”
রোববার বেলা ১২টায় বাসা এই সাংসদের মরদেহ নেওয়া হয় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। সেখান থেকে বিকাল ৩টায় নেওয়া হবে সংসদ ভবনে।
সেখানে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংসদ সদস্য ও বিভিন্ন রাজনেতিক দলের পক্ষ থেকে প্রয়াত এই রাজনীতিবিদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে।
সোমবার সকালে হেলিকপ্টারে করে সিলেটে নেওয়ার পর আরেক দফা শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে দুপুরে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মরদেহ সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে তার গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হবে। বিকাল ৩টায় সেখানেই হবে তার শেষকৃত্য।
বর্ণময় রাজনৈতিক জীবন
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নিজের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তার জন্ম ১৯৩৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি, সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার আনোয়ারাপুরে। অবশ্য তার পাসপোর্টে জন্ম সাল ১৯৪৫ এবং জাতীয় সংসদে থাকা সাংসদদের জীবন বৃত্তান্তে ১৯৪৬ সালের কথা লেখা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর করে ঢাকা সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে আইনে ডিগ্রি নেন সুরঞ্জিত। পরে কিছুদিন আইন পেশায় যুক্তও ছিলেন।
ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত সুরঞ্জিত ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের নির্বাচনে ন্যাপ থেকে জয়ী হয়ে আলোচনার জন্ম দেন।
একাত্তরে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন ৫ নম্বর সেক্টরের সাব কমান্ডার হিসেবে। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি মোট সাতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
সুরঞ্জিত ১৯৭৯ সালের সংসদে ছিলেন একতা পার্টির প্রতিনিধি হয়ে। ১৯৯১ সালের সংসদে গণতন্ত্রী পার্টি থেকে নির্বাচিত হন তিনি।
ছোট দলের বড় নেতা হিসেবে রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিত সুরঞ্জিত আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার পর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য অন্য আসনে উপনির্বাচনে বিজয়ী হন তিনি। এরপর অষ্টম, নবম ও দশম সংসদেও তিনি নির্বাচিত হন।
২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে সংস্কারের প্রস্তাব তোলাদের দলে সুরঞ্জিতও ছিলেন।
নির্বাচনের পর হাসিনার ‘সংস্কারপন্থি’ হিসেবে পরিচিত অন্যদের মত সুরঞ্জিতকেও মন্ত্রিসভার বাইরে রাখা হয়। পরে দলের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকেও বাদ পড়েন সুরঞ্জিতের মতো ‘সংস্কারপন্থি’ নেতারা, তাদের কয়েকজনের স্থান হয় ‘ক্ষমতাহীন’ উপদেষ্টা পরিষদে।
জরুরি অবস্থার সময় ভূমিকা নিয়ে দলে ‘কোনঠাসা’ হওয়ার প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমে সাবলীল এই বর্ষীয়ান এই রাজনীতিককে এটাও বলতে দেখা যায়, ‘বাঘে ধরলে ছাড়ে, শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়ে না’।
সরকারের তিন বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর সুরঞ্জিতেরই মন্ত্রিসভায় স্থান হয়, পান নবগঠিত রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, “আমি শেষ ট্রেনের যাত্রী।”
বাকপটু সুরঞ্জিত দেশের প্রথম রেলমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরই রেল বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত করার স্বঙ্কল্প জানিয়ে বলেছিলেন, রেলের ‘কালো বিড়ালটি’ খুঁজে বের করতে চাই। কিন্তু পাঁচমাসের মাথায় এপিএসের গাড়িতে বিপুল অর্থ পাওয়া গেলে তিনি চাপে পড়ে যান।
সহকারীর অর্থ কেলেঙ্কারির দায় মাথায় নিয়ে তিনি পদত্যাগ করলেও তা গ্রহণ না করে সে সময় তাকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসাবে রাখেন শেখ হাসিনা।
দশম সংসদে নির্বাচিত হওয়ার পর সুরঞ্জিতকে আর মন্ত্রিত্বে ফেরানো হয়নি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে সুরঞ্জিত ছিলেন সবার ছোট। তিন ভাই আগেই মারা গেছেন; একমাত্র বোন কলকাতায় বসবাস করছেন।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী জয়া সেনগুপ্ত একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। সৌমেন সেনগুপ্ত তাদের একমাত্র সন্তান।