আল গোরকে রামপাল দেখার আমন্ত্রণ হাসিনার

সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাটের রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ‌্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে উদ্বেগের জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও আন্তর্জাতিক পরিবেশ আন্দোলনের নেতা আল গোরকে বাংলাদেশে এসে নিজের চোখে ওই এলাকা ঘুরে দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Jan 2017, 03:16 PM
Updated : 21 Jan 2017, 11:08 AM

রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সুন্দরবনের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে মন্তব‌্য করে এর বিরোধিতাকারীদের উদ্দেশ‌্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

সুইজারল‌্যান্ডের ডাভোসের কংগ্রেস সেন্টারে গত বুধবার সন্ধ্যায় ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘লিডিং দ্য ফাইট এগেইনস্ট ক্লাইমেট চেঞ্জ’ (জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব প্রদান) শীর্ষক প্লেনারি সেশনে আলোচনার এক পর্যায়ে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রসঙ্গ ওঠে।

ওই সেশনের একটি ভিডিও নিজের ফেইসবুক পেইজে শেয়ার করেছেন তথ‌্য-প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সৌরশক্তি ব্যবহারের উপর গুরুত্ব আরোপ করে শেখ হাসিনার পাশে বসে আল গোর বলেন, গত বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত সৌরশক্তির প্যানেল স্থাপনকারী দেশ ছিল। কিন্তু এখন সেই গতি ধীর হয়ে গেছে। এখন সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট (বাদাবন), বেঙ্গল টাইগারের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল সুন্দরবনে একটি নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। হাজার হাজার মানুষ এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে।

“আমার পরামর্শ হল, দূষণকারী ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবেন না।”

এর পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব‌্যবহার দ্বিগুণ করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে মুহম্মদ ইউনূসের সংগঠনসহ বাংলাদেশের অন্যান্য বেসরকারি সংস্থা নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের প্যানেল বসানোর ক্ষেত্রে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছে।

বিল ক্লিনটনের ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরের বক্তব্যের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে রামপালে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এই বিদ‌্যুৎ প্রকল্পে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না।

আলোচনার এক পর্যায়ে রামপাল নিয়ে সংশয় দূর করতে আল গোরকে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি আপনাকে নিজে ওই জায়গায় নিয়ে যাব। আপনি নিজের চোখে সব দেখবেন এবং আমি বলছি, সেখানে কাভার্ড নৌযানে করে কয়লা বহন করা হবে, খোলা নৌযানে নয়। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র কিছুতেই পরিবেশের ক্ষতি করবে না।”

বক্তব্যের মধ্যেই আল গোর হাসতে হাসতে বলেন, “আমি আসতেও পারি।”

শেখ হাসিনা তার বক্তব‌্যে রামপাল নিরাপদ করতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, “আমি জানি না, মানুষ কেন এই ইস্যুটা তুলছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বিশ্বের সব জায়গাতেই রয়েছে। ভালো কথা...আমরা কোথায় এটা নির্মাণ করছি। এটা সুন্দরবন থেকে অনেক অনেক দূরে নির্মাণ করা হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, পরিবেশ যাতে আক্রান্ত না হয়, সেজন্য আমরা সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি, যাতে সুন্দরবনের ক্ষতি না হয়। এটি একটি সুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, খুবই আধুনিক। আমাদের পরিবেশ রক্ষায় সব ধরনের উদ্যোগ আমরা নিয়েছি।”

দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় ২০০০ সালে গড়ে তোলা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “এটাতো নতুন নয়, আমাদের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আগেরও রয়েছে, যেটা অতো আধুনিক নয়। দিনাজপুর জেলায়, ঘনবসতিপূর্ণ এই জেলায় পরিবেশের ওপর নেতিবাচক কোনো প্রভাব পড়েনি।

“সেখানে ফসল হচ্ছে, প্রচুর গাছপালা রয়েছে, ফলজ গাছ অনেক, এমনকি খুব ভালো আমের ফলনও সেখানে হয়। আপনারা গেলে দেখবেন, সেখানে পরিবেশের ওপর কোনো প্রভাব পড়েনি।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার বিষয়টি নিয়ে ‘অত্যন্ত সচেতন’। রয়েল বেঙ্গল টাইগার এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে আক্রান্ত হবে না।

“যারা এই বিষয়টাকে সামনে আনছেন, আমি তাদের সশরীরে সেখানে গিয়ে সব দেখে আসতে বলেছি। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জায়গাটা সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে এবং সুন্দরবনের যে এলাকা বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষিত হয়েছে, তার থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ৬৫ থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে। এই কেন্দ্রটি একটা নদীর তীরে এবং এটাকে কেন্দ্র করে ওই এলাকা উন্নত হচ্ছে, যে কারণে স্থানীয় মানুষ খুশি।”

তিনি বলেন, যারা ২০০০ সালে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ কেন্দ্র নিয়ে কথা বলেনি, কিন্তু এখন সুন্দরবন এলাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে কথা বলছে।

“প্রশ্ন জাগে, তার মানে কি তারা মানুষের চেয়ে সুন্দরবন ও বাঘ নিয়ে বেশি চিন্তিত?”

পরিবেশ নিয়ে তার সরকারের কার্যক্রম তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা অনেক উদ্যোগ নিয়েছি.. আমাদের উপকূলীয় এলাকায় সবুজ বেষ্টনী তৈরি করেছি, আমরা আমাদের বন বৃদ্ধি করেছি। আমি যখন ১৯৯৬ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হই, তখন বন ছিল মাত্র ৭ শতাংশ, ক্রমান্বয়ে আমরা ১৭ শতাংশ করতে পেরেছি। আমাদের টার্গেট হচ্ছে এটাকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত করা।

“প্রতিবাদ হচ্ছে এটা ঠিক। কিন্তু যারা প্রতিবাদ করছে তারা এর প্রকৃত কারণ, প্রকৃত প্রভাব বলতে পারে না।”

আল গোর বলেন, ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টার ওই স্থানটি রক্ষা করতে এবং পরিবেশ দূষণকারী বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ না করতে বাংলাদেশকে অনুরোধ করেছে। যে নদীর কথা প্রধানমন্ত্রী বলছেন, সেখানে এরই মধ্যে কয়েকটি কয়লাবাহী জাহাজডুবির ঘটনা ঘটেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাঁচ হাজারের মতো ঘনমিটার পানি ওই নদীতে ফেলার বিষয়টি নিয়েও আপত্তি উঠেছে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য কনজারভেশন অব নেচার এলাকাটি (সুন্দরবন) রক্ষার আবেদন জানিয়েছে।

“আমি আশা করছি, সময় থাকলে সংবাদমাধ্যমগুলো এই ইস্যু এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোয় মনোযোগী হবে।”

শেখ হাসিনা বলেন, “আমি দেশের প্রধানমন্ত্রী, জনগণের কথা ভেবে জনগণের জন্য উন্নয়ন আমাকে করতেই হবে। যেসব মানুষ এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছেন, তাদের মনে হয়তো অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্র আমাদের সুন্দরবন বা বাঘের কোনো ক্ষতি করবে, সেটা তারা কোনোভাবে প্রমাণ করতে পারবে না।”

এই প্লেনারি সেশনে নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী এরনা সোলবার্গ, এইচএসবিসির সিইও স্টুয়ার্ট গালিভার, কফকো এগ্রির সিইও জিংগতাও চি বক্তব্য দেন।