‘বিচার পাইছি, চোখের পানিতো থামবে না’

বিচারের রায়ে স্বস্তি এসেছে তিন বছর পর, কিন্তু পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারানোর ধাক্কা আর স্বজন হারানোর বেদনা এখনও ঝরছে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় নিহতদের পরিবারের সদস্যদের চোখে-মুখে।

নিজস্ব প্রতিবেদকও নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Jan 2017, 02:45 PM
Updated : 16 Jan 2017, 02:46 PM

সোমবার নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ আদালতে চাঞ্চল‌্যকর এ মামলার রায় ঘোষণার পর আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত স্বজনদের অনেকেই বলেছেন কষ্টের জীবন বয়ে বেড়ানোর বথা।

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে নারায়ণগঞ্জ আদালতে একটি মামলায় হাজিরা দিয়ে ঢাকার ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার লামাপাড়া থেকে অপহরণ করা হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন, সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, স্বপনের গাড়ি চালক জাহাঙ্গীরকে । 

ওই ঘটনা দেখে ফেলায় নজরুলের গাড়ির পেছনে থাকা আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিমও অপহৃত হন।

তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে মেলে ছয়জনের লাশ। ১ মে নজরুলের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটনের লাশও নদীতে ভেসে ওঠে।

ওই ঘটনায় সারা দেশে আলোচনার ঝড় ওঠে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে র‌্যাব-১১ এর শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে, সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নূর হোসেন এলাকায় আধিপত্য নিয়ে বিরোধ থেকে নজরুলকে হত‌্যার পরিকল্পনা করেন এবং আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে র‌্যাব সদস্যদের দিয়ে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটান।

সোমবার আদালতের রায়ে ৩৫ আসামির মধ‌্যে নূর হোসেন ও সাবেক তিন র‌্যাব কর্মকর্তাসহ ২৬ জনকে দেওয়া হয় মৃত‌্যুদণ্ড। বাকি নয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন বিচারক।

সাংবাদিকরা রায়ের পর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে নিহত তাজুল ইসলামের বাবা আবুল খায়ের বলেন, “ফাঁসি হয়েছে, সাজা হয়েছে, আমরা সন্তুষ্ট। বিচার পাইছি, সন্তান হারিয়েছি... সন্তানকেতো আর ফিরে পাব না; চোখের পানিতো থামবে না।”

ছেলের কথা বলতে বলতে ধরে আসে আবুল খায়েরের কণ্ঠ। এরপর পাশে থাকা আরেক ছেলে সাইফুল ইসলাম রাজুকে কথা বলতে বলেন তিনি।

রায় দ্রুত কার্যকর চান নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি

নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের ব্যবসা দেখাশোনা করতেন তাজুল। ওই চাকরিতে যে আয় হত, তা দিয়ে কষ্টেসৃষ্টে চলত তার পরিবার। এখন সেই আয়ের পথও বন্ধ।  

র‌্যাবের কয়্জেন সদস‌্যের নেতৃত্বে যে পরিকল্পনা নিয়ে ওই হত‌্যাকাণ্ড ঘটানো হয়, তার ভাবলে এখনও আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন আবুল খায়ের।

“ওরা কিলিং মিশন নিয়ে নামছিল, আপনে সামনে আসলে আপনাকেও খুন করত। যাকে পাইত তাকে খুন করত। আজকে তাদের বিচার হইছে, এখন সাজা কার্যকর হোক।”

তাজুলের ভাই সাইফুল ইসলাম রাজু বলেন, “লাশ এতোটা বিভৎস ছিল, মাকে আমার ভাইয়ের লাশ দেখাতে পারি নাই, উনি এটা দেখে সহ্য করতে পারতেন না।

এ মামলার আসামিদের মধ‌্যে কয়েকজন সদস‌্য আদালতে যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন, তাতে হত‌্যাকাণ্ডের ভয়ঙ্কর বিবরণ উঠে আসে।

তারা জানান, অপহরণের পর সাতজনকে চেতনানাশক ইনজেকশন দিয়ে অচেতন করা হয়। পরে মুখে পলিথিন পেঁচিয়ে হত্যা করা হয় শ্বাস রোধ করে। লাশগুলো শীতলক্ষ‌্যায় ফেলে দেওয়ার সময় ডুবে যাওয়া নিশ্চিত করতে বেঁধে দেওয়া হয় ইটের বস্তা। আর লাশ যাতে ফুলে না ওঠে সেজন‌্য চিরে ফেলা হয় লাশে পেট।

রাজু বলেন, “বিভৎস ওই ঘটনা তদন্তে বের হয়ে আসছে। আজকে আমরা বিচার পেয়েছি। না হলে আজও হয়তো ভাইয়ের লাশ খুঁজে বেড়াতে হত।”

স্বামীকে হারিয়ে পাঁচ সন্তানকে নিয়ে ‘বড় বেকায়দায়’ আছেন চন্দন সরকারের গাড়িচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিমের স্ত্রী হনুফা বেগম।

ইব্রাহিমের বাবা প্রতি মাসে দেন এক বস্তা চাল, আর নিজের বাবার কাছ থেকে হানুফা পান ৫০০ টাকা করে। সেই সঙ্গে নিজে দর্জির কাজ করে সংসার চালান।

অভাবের কারণে তিন মেয়েকে দিয়েছেন এতিমখানায়; ওই তিন মেয়ে আর দুই ছেলের একজনকে নিয়ে রায় শুনতে আদালত প্রাঙ্গণে এসেছিলেন হনুফা। ফাঁসির রায় কার্যকর হলে শেষ বিচার পাওয়া যাবে- এটাই তার একমাত্র সান্ত্বনা।

নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম

নিহত নজরুল ইসলামের ছোট মেয়ে তানহা ঢাকার ভিকারুন্নিসা স্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। বড় ছেলে নাঈম রাজউক মডেল স্কুল ও কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে গতবছর। ছোট ছেলে ফাহিম একই প্রতিষ্ঠানের পড়ে দশম শ্রেণিতে।

স্বামীর ওয়ার্ডে পরে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি। অবশ‌্য গত ডিসেম্বরে ভোটে দাঁড়িয়ে পরাজিত হন তিনি। তার এবং নজরুলের রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে যে আয় হয় তা দিয়েই চলছে তাদের সংসার।

সেলিনা ইসলাম বিউটি রায়ের পর বলেন, “আমরা সন্তুষ্ট। কিন্তু আমরা চাই, এই রায় দ্রুত কার্যকর হোক। হাই কোর্টে যাতে এই রায় বহাল থাকে।”

প্যানেল মেয়র নজরুল সেদিন নিজের গাড়ি না নিয়ে তার বন্ধু যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামান স্বপনের গাড়ি ব্যবহার করেছিলেন। নজরুলের সঙ্গে স্বপনকেও সেদিন হত‌্যা করা হয়। স্বপনের দুই মেয়ে মাহি ও স্বর্ণালীকে এখন নির্ভর করতে হয় চাচাদের ওপর।

‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ হলেও রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়ে স্বপনের ভাই মিজানুর রহমান রিপন আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের বলেন, “রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। এটাতো নিম্ন আদালতের রায়। তারাতো উচ্চ আদালতেও যেতে পারে। রায় যতদিন কার্যকর না হবে ততোদিন আমাদের নিরাপত্তাজনিত শঙ্কা থেকে যাবে।”

স্বপনের গাড়ির চালক জাহাঙ্গীর যখন নিহত হন, তখন তার স্ত্রী নুপুর আট মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা। ওই বছরের ৪ জুলাই নুপুর কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। শিশুসন্তান আর নিজের জীবন বাঁচাতে নুপুর কাজ নেন এক গার্মেন্টে। স্বল্প আয়ে কষ্টেসৃষ্টে দিন চালাতে হচ্ছে তাকেও।

চন্দন সরকারের মেয়ে সুস্মিতা সরকারও রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, আসামিদের সাজা দ্রুত কার্যকর হোক- এটাই তাদের চাওয়া।

“রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। আমার বাবা সারাজীবন ন্যায় বিচারের জন্য কাজ করেছেন। আজকে তার আত্মা শান্তি পাবে।”