সাত খুনের ঘটনাক্রম

মুজিবুল হক পলাশ, নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Jan 2017, 12:52 PM
Updated : 18 Jan 2017, 04:29 PM

তিন বছর আগে নারায়ণগঞ্জে কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনাটি আলোড়ন তুলেছিল সারাদেশে।

হত্যাকাণ্ডের পর উত্তেজিত জনতা সন্দেহভাজন কয়েকজনের বাড়িঘর ও দপ্তর জ্বালিয়ে দেয়। পরে বেরিয়ে আসে যে এই হত‌্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরই কেউ কেউ, যা নিয়ে শোরগোল দেশের সীমানাও ছাড়িয়ে যায়।

হত‌্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি আরেক কাউন্সিলর নুর হোসেনের পালিয়ে যাওয়া নিয়েও সমালোচনা ওঠে। পলাতক অবস্থায় নুর হোসেনের সঙ্গে সংসদ সদস‌্য এ কে এম শামীম ওসমানের ফোনালাপ প্রকাশ হলে তা নিয়েও ব‌্যাপক আলোচনা ওঠে। নুর হোসেন পরে ভারতে ধরা পড়েন, ফিরিয়ে আনা হয় তাকে।

হত্যাকাণ্ডে নিহতদের স্বজনদের করা দুই মামলায় ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ৩৮টি শুনানির পর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সোমবার রায় ঘোষণা করেন।

শীতলক্ষ‌্যায় ভেসে ওঠে হাত পা-বাঁধা লাশ

                        >> ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালতে মামলায় হাজিরা দিতে যান সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম। গাড়িতে ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়াম এলাকা থেকে অপহৃত হন তারা পাঁচজন। একই সময়ে অপহৃত হন আরেক গাড়িতে থাকা আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক।

                        >> পরদিন নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেনসহ ছয়জনকে আসামি করে ফতুল্লা থানায় অপহরণের মামলা করেন। যেটি পরে হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়।

খুন করে এই সাতজনের লাশ ডুবিয়ে দেওয়া হয় নদীতে

  >> অপহরণের ঘটনায় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার; ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ সব এসআইকে অন্য জেলায় বদলি করা হয়।

                       >> ৩০ এপ্রিল বিকালে শীতলক্ষ্যা নদীর বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া শান্তির নগর এলাকা থেকে নজরুল, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিমের হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করা হয়।

শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তোলা হচ্ছে একের পর এক লাশ; পাশে (সর্ববামে) ক্রন্দনরত নজরুল ইসলামের স্ত্রী (২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিলের ছবি)

                        >> পরদিন একই জায়গায় মেলে নজরুলের আরেক বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটনের লাশ।

                        >> সব লাশের পেটে ছিল আঘাতের চিহ্ন। প্রতিটি লাশ ইটভর্তি দুটি করে বস্তায় বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের জানাজায় হাজারো মানুষ (২০১৪ সালের ১ মে’র ছবি)

                        >> উত্তেজিত জনতা ১ মে সকালে কাউন্সিলর নূর হোসেনের কার্যালয়; রাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হাজি মো. ইয়াসিনের বাড়ি  ভাংচুর করে ও সংলগ্ন কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।

আগুনে জ্বলছে শিমরাইলে নুর হোসেনের কার্যালয়

                        >> ৭ মে চন্দনের জামাতা বিজয় কুমার পাল অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে ফতুল্লা থানায় আরেকটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

র‌্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ       

                        >> ৪ মে নজরুলের শ্বশুর অভিযোগ করেন, র‌্যাবের তিন কর্মকর্তা লেফটেন‌্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, লেফটেন‌্যান্ট কমান্ডার এম এম রানা ও মেজর আরিফ হোসেন ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে এ সাতজনকে অপহরণের পর খুন করেন।

প্রশাসনিক তদন্ত কমিটির সামনে নিহতদের স্বজনরা (২০১৪ সালের ১০ ম ‘র ছবি)

                        >> সেনা কর্মকর্তা তারেক সাঈদ ত্রাণ ও দুর্যোগ ব‌্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা। তিনি র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক ছিলেন। নৌবাহিনীর কর্মকর্তা রানা ও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা আরিফও র‌্যাব-১১ এ ছিলেন। 

ঘটনাস্থলে তদন্তে প্রশাসনিক তদন্ত কমিটি (২০১৪ সালের ৭ মে’র ছবি)

                        >> ১১ মে নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতির তৎকালীন সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন, সদস‌্য মাহবুবুর রহমান ইসমাইল ও চন্দনের জামাতা বিজয় কুমার পালের রিট আবেদনে হাই কোর্ট তিন র‌্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়।

                        >> পরদিন পুলিশের পক্ষ থেকে গ্রেপ্তারে সহযোগিতা চেয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়।

                        >> প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ১৫ মে পুলিশকে চিঠি দিয়ে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিওর (সিআরপিসি) অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলে। ওইদিন রাতেই মিলিটারি পুলিশের সহায়তায় ঢাকা সেনানিবাসের বাসভবন থেকে তারেক সাঈদ ও মেজর আরিফ হোসেনকে গ্রেপ্তার করে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ।

গ্রেপ্তারের পর আদালতে নেওয়া হচ্ছে আরিফ হোসেনকে (২০১৪ সালের ১৭ মে’র ছবি)

গ্রেপ্তারের পর আদালতে নেওয়া হচ্ছে তারেক সাঈদ মোহাম্মদকে (২০১৪ সালের ১৭ মে’র ছবি)

                        >> পরদিন রাতে নৌ-বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা এম এম রানাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানা পুলিশের কাছে তুলে দেন।

গ্রেপ্তারের পর আদালতে নেওয়া হচ্ছে এম এম রানাকে (২০১৪ সালের ২৫ মে’র ছবি)

                       >> প্রতিরক্ষা বাহিনীর এই তিন কর্মকর্তাকেই বাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হয়। 

পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার নুর হোসেন (২০১৪ সালের ১৪ জুনের ছবি)

                        >> মামলার প্রধান আসামী কাউন্সিলর নুর হোসেনকে ওই বছরের ১৪ জুন গভীর রাতে কলকাতার দমদম বিমানবন্দর সংলগ্ন বাগুইআটি থানা পুলিশ আটক করে।

                        >> ২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বর বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে তাকে বাংলাদেশের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

দেশে ফেরত আনার পর ২০১৫ সালের ১৪ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের আদালতে নুর হোসেন

১৪ নভেম্বর তাকে নারায়ণগঞ্জ আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাকে জেল হাজতে পাঠান।

কারাগারে ২৩, পলাতক ১২

                        >> হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৫ জনকে আসামি করে ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ গঠন করে আদালত।

                        >> এদের মধ্যে ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যার ১৭ জন র‌্যাব সদস্য। পলাতক ১২ জনের মধ্যেও র‌্যাবের ৮ জন রয়েছেন।

শুনানি চলাকালে একদিন আদালতে তারেক সাঈদ মোহাম্মদ

কারাগারে আছেন নুর হোসেন, তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, মাসুদ রানা, হাবিলদার এমদাদুল হক, আরওজি-১ আরিফ হোসেন,  ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়ব, কনস্টেবল মো: শিহাব উদ্দিন, এসআই পুর্নেন্দ বালা, কর্পোরাল রুহুল আমিন, এএসআই বজলুর রহমান, নূর হোসেনের সহযোগী আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু, রহম আলী, আবুল বাশার, হাবিলদার নাসির উদ্দিন, এএসআই আবুল কালাম আজাদ, সৈনিক নুরুজ্জামান, কনস্টেবল বাবুল হাসান, সৈনিক আসাদুজ্জামান নূর ও নূর হোসেনের সহযোগী মোর্তুজা জামান চার্চিল।

তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, আরিফ হোসেন ও এম এম রানা

ধরা পড়েননি কর্পোরাল মো. মোখলেছুর রহমান, সৈনিক আব্দুল আলীম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, সৈনিক আল আমিন, সৈনিক তাজুল ইসলাম, সার্জেন্ট এনামুল কবীর, এএসআই কামাল হোসেন, কনস্টেবল হাবিবুর রহমান, নুর হোসেনের সহযোগী সেলিম, সানাউল্লাহ ছানা, ম্যানেজার শাহজাহান, ম্যানেজার জামাল উদ্দিন।

একটি মামলার বাদী সেলিনা ইসলাম বিউটি

     >> গ্রেপ্তার আসামিদের ২১ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

                        >> মামলায় ১২৭ জনকে সাক্ষী করা হলেও আদালত ১০৬ জনের সাক্ষ্য নেন।

                        >> জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেনের আদালতে ৩৮টি শুনানির পর ১৬ জানুয়ারি রায় ঘোষণার দিন ধার্য হয়।