২০১৬: সব ছাপিয়ে জঙ্গিবাদ

কয়েকটি অমীমাংসিত হত‌্যাকাণ্ড, পৌনে দুইশ ‘বিচারবহির্ভূত হত‌্যা’ আর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ছাপিয়ে ২০১৬ সাল বাংলাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবে জঙ্গিবাদের নতুন উত্থান এবং প্রতিরোধের বছর হিসেবে।   

গোলাম মুজতবা ধ্রুবকামাল হোসেন তালুকদার ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Dec 2016, 06:57 PM
Updated : 31 Dec 2016, 07:38 PM

লেখক, শিক্ষক, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট, ভিন্নমতের অনুসারী ও বিদেশিদের ওপর উগ্রপন্থি আঘাতে জঙ্গিবাদের যে নতুন শঙ্কা নিয়ে বাংলাদেশ ২০১৬ সাল শুরু করেছিল, তার ধারাবাকিতা চলে বছরের ঠিক মাঝামাঝি পর্যন্ত। 

এরপর রোজার মধ‌্যে ১ জুলাই রাতে নিরাপত্তায় ঘেরা কূটনৈতিকপাড়া গুলশানের এক ক‌্যাফেতে ঘটে বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন জঙ্গি হামলার ঘটনা।

ঠিক সাত দিনের মাথায় ঈদের সকলে শোলাকিয়ায় ঈদ জামাতের পথে জঙ্গি হামলা আবারও কাঁপিয়ে দেয় বাংলাদেশকে।   

বছরের বাকি অর্ধেক সময়ে একের পর এক জঙ্গি আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চলে; শিরোনাম হয় তাদের সাফল‌্যের খবর।

এ বছর কুমিল্লায় কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত‌্যার ঘটনা যেমন দাগ কেটেছে মানুষের মনে, সিলেটে কলেজছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিসকে কুপিয়ে হত‌্যার চেষ্টা ক্ষুব্ধ করেছে সাধারণ মানুষকে।

পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতুকে কারা প্রকাশ‌্যে রাস্তায় গুলি করে মারল, আর চট্টগ্রামের ছাত্রলীগ নেতা সত‌্যিই আত্মহত‌্যা কিরেছেন, নাকি তিনি হত‌্যার শিকার- সে রহস‌্যের কিনারা হয়নি বছর শেষেও। 

আর ২০১৬ সাল শেষ হয়েছে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে বাড়িতে ঢুকে গুলি চালিয়ে হত্যার ঘটনার মধ‌্য দিয়ে।

হামলার লক্ষ‌্য ভিন্নমত

রক্তের দাগই বলে দেয় পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের এই সড়কের পাশে খুন করা হয়েছিল অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নাজিমুদ্দিন সামাদকে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্রকে প্রকাশ্য সড়কে খুনের পরদিন ৭ এপ্রিল সেখানে তদন্তে পুলিশ কর্মকর্তারা।

৭ জানুয়ারি: ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বালেখাল বাজারে হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক সমির আলিকে হত্যা করা হয়, যিনি ২০০১ সালে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। খুনিরা চেম্বারে ঢুকে সমিরকে ছুরি মেরে পালিয়ে যায়। পরে আইএস এর দায় স্বীকারের বার্তা আসে।

১৫ মার্চ: ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের একাংশের ঝিনাইদহ জেলা শাখার সেক্রেটারি আব্দুর রাজ্জাককে কালীগঞ্জ উপজেলার নিমতলা বাসস্ট্যান্ডে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। রাজ্জাক পেশায় ছিলেন হোমিও চিকিৎসক। আইএস ওই হত্যার দায় স্বীকার করেছে বলে সে সময় খবর আসে।

৮ এপ্রিল: রাতে রাজধানীর সূত্রাপুরের একরামপুর মোড়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিমুদ্দিন সামাদকে।

২৩ এপ্রিল: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করীম সিদ্দিকীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

২৫ এপ্রিল: ঢাকার কলাবাগানের লেক সার্কাসে বাসায় ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ইউএসএআইডি এর কর্মসূচি কমকর্তা জুলহাজ মান্নান এবং তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়কে। তারা দুজনেই ছিলেন সমকামী অধিকার কর্মী।

৩০ এপ্রিল: টাঙ্গাইলে দর্জি নিখিল চন্দ্র জোয়ারদারকে তার দোকানের সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

১৪ মে: বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি চাকপাড়া বৌদ্ধ বিহারের ভিক্ষু মং শৈ উ’ কে গলা কেটে হত্যা করা হয়।

২০ মে: কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বটতৈল ইউনিয়নে শিশির মাঠ এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক মীর সানোয়ার হোসেনকে।তাকে বাঁচাতে গিয়ে আহত হন তার বন্ধু ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামসুজ্জামান।

৫ জুন: নাটোরে খ্রিস্টান মুদি দোকানি সুনীল গোমেজকে তার দোকানে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

৭ জুন: ঝিনাইদহের নলডাঙ্গা মন্দিরে পুরোহিত অনন্ত গোপাল গাঙ্গুলীকে গাঁয়ের রাস্তায় গলা কেটে হত্যা করা হয়।

১ জুলাই: ঝিনাইদহ সদর উপজেলার উত্তর কাষ্ঠসাগরা গ্রামের শ্রী শ্রী রাধামদন গোপাল বিগ্রহের (মঠ) সেবায়েত শ্যামানন্দ দাসকে মোটর সাইকেলে আসা তিন যুবক কুপিয়ে হত্যা করে।

হলি আর্টিজান বেকারিতে ১ জুলাই রাতে জঙ্গি হানার পর সকালে কমান্ডো অভিযানের প্রস্তুতি সেনাসদস্যদের; অভিযানে সব জঙ্গি মারা পড়ার আগে রাতেই তারা হত্যা করে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে। জঙ্গিদের ঠেকাতে গিয়ে শুরুতেই নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা।

জঙ্গিবাদ নতুন মাত্রায়

১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে অস্ত্র নিয়ে ঢুকে পড়ে কয়েক তরুণ, শুরু হয় গুলি আর বিস্ফোরণ। ভেতরে আটকা পড়েন কয়েক ডজন দেশি-বিদেশি অতিথি। তৈরি হয় জিম্মি সঙ্কট।   

ঘটনার মাত্রা বুঝতে না পেরে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতে গিয়ে জঙ্গিদের ছোড়া বোমায় নিহত হন গোয়েন্দা পুলিশের একজন সহকারী কমিশনার ও বানানী থানার ওসি। ততক্ষণে পুরো বিশ্বের সংবাদমাধ‌্যমের নজর কেন্দ্রিভূত হয়েছে গুলশানে।

রাতভর উৎকণ্ঠার মধ‌্যেই হলি আর্টিজানের ভেতরে রক্তাক্ত লাশের ছবি ইন্টারনেটে আসে। বলা হয়, এ ঘটনা ঘটিয়েছে বাংলাদেশে আইএস এর অনুসারীরা। 

পরদিন ভোরে শুরু হয় সামরিক বাহিনীর সদস‌্যদের অভিযান; নিহত হন ছয় হামলাকারী। জানা যায়, ১৭ বিদেশিসহ আটকে পড়া ২০ জনকে অভিযানের আগেই হত‌্যা করেছে জঙ্গিরা। 

গুলশান হামলার পর এক ভিডিও বার্তায় আইএসের নামে ইন্টারনেটে আসা এক ভিডিওতে বাংলাদেশে নতুন হামলার হুমকি দিতে দেখা যায় তিন তরুণকে।

রক্তাক্ত শোলাকিয়া

গুলশান হামলার রেশ না কাটতেই ৭ জুলাই ঈদের সকালে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের সবচেয়ে বড় ঈদ জামাতের মাঠের কাছে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের ওপর বোমা হামলা চালানো হয়।

হামলার প্রথম ধাক্কাতেই দুই কনস্টেবল নিহত হন। এরপর শুরু হয় দুই পক্ষের গোলাগুলি। এর মধ‌্যে নিজের বাড়ির রান্না ঘরে ছিটকে আসা গুলিতে প্রাণ যায় এক নারীর। পুলিশের গুলিতে নিহত হয় এক জঙ্গি, যার পায়জামায় ছিল চাপাতি রাখার বিশেষ পকেট।

গুলশান হামলার পর রাজধানীর কল্যাণপুরে এই তাজ মঞ্জিলে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ; ২৬ জুলাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে সেখানে নিহত হয় নয়জন জঙ্গি।

প্রতিরোধ পর্ব

গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার পর জঙ্গি দমনে সাঁড়াশি অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। পুলিশে সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এসব অভিযানে এ পর্যন্ত ৩৩ জঙ্গি নিহত হয়েছে।

গুলশান হামলার ২৬ দিনের মাথায় কল্যাণপুরের ‘তাজ মঞ্জিল’ নামের একটি ভবনে নয়জন, ২৭ অগাস্ট নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় ‘নব‌্য জেএমবি’র শীর্ষনেতা তামিম আহমেদ চৌধুরীসহ তিনজন, ২ সেপ্টেমর ঢাকার রূপনগরের শিয়ালবাড়ী এলাকায় নব্য জেএমবির সামরিক শাখার প্রশিক্ষক জঙ্গি জাহিদুল ইসলাম, ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরে তানভির কাদেরী নিহত হন।

এরপর ৮ অক্টোবর গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও আশুলিয়ায় একদিনে র‌্যাব ও পুলিশের পৃথক চার অভিযানে সন্দেহভাজন ১২ জঙ্গি নিহত হন।

সর্বশেষ ২৪ ডিসেম্বর দক্ষিণখান থানার পূর্ব আশকোনায় এক বাড়িতে অভিযানে এক নারী জঙ্গি গ্রেনেড ফাটিয়ে আত্মঘাতী হন, নিহত হয় এক কিশোর জঙ্গি।

পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটির প্রধান ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, “বছরজুড়ে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা ছিল এবং হামলা হয়েছেও, বিচ্ছিন্নভাবে টার্গেটেড কিলিং হয়েছে। হলি আর্টিজেনের মতো হামলা হয়েছে, যা বাংলাদেশের মানুষ কখনও কল্পনাও করেনি।

“এই ধরনের ঘটনা সারা বছর জুড়ে ছিল। তবে হলি আর্টিজেন ও শোলাকিয়ার ঘটনার পর সারাদেশের মানুষ আমরা যেটুকু বুঝতে পেরেছি- আতঙ্কগ্রস্ত ছিল। বিদেশিরা এই দেশে আর বিনিয়োগ করবে কিনা বা আদৌ এদেশে থাকবে কিনা এ রকম চিন্তা করছিল।”

তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান আর সাধারণ মানুষের জঙ্গিবাদ বিরোধী মনোভাবের কারণে বছর শেষে সেই শঙ্কা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা গেছে বলে মনে করেন মনিরুল।

তার দাবি, সংগঠনের অনেকে নিহত হয়ে যাওয়ায়, অর্থ যোগানদাতাদের অনেকে নিহত হওয়ায় জঙ্গি) যে সাংগঠনিক শক্তি তা অনেকটাই কমে গেছে।

“তারপরও যেহেতু রেডিক্যালাইজ মানুষ কিছু রয়ে গেছে, তাদের নেতা বা কর্মী কেউ কেউ বাইরে রয়েছে। তারা নতুনভাবে চেষ্টা নিচ্ছে সংগঠিত হয়ে তৎপরতা চালানোর। তেমনিভাবে আমাদেরও (দমনের) প্রচেষ্টা আছে। আমাদের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের ‘ক্যাপাসিটি’ বৃদ্ধি পেয়েছে, সাধারণ মানুষ সচেতন হয়েছে।”

আলোচিত হত‌্যা

শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীরাই নয়, সোহাগী জাহান তনুর জন্য সারা বাংলাদেশেই মানুষ নেমেছিল রাজপথে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের এই ছাত্রীর লাশ ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় তার বাসার কাছে পাওয়া যায়। ময়নাতদন্ত নিয়ে নানা নাটকীয়তার পর বছর গড়ালেও এখনও জানা যায়নি কারা খুনি।

সোহাগী জাহান তনু:
২০ মার্চ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু খুন হন। ওইদিন রাতে কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের ভেতরের একটি ঝোপ থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।

প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে চিকিৎসকরা তনুকে হত্যার আগে ধর্ষণের কোনো প্রমাণ তারা পাননি বলে জানান।

কিন্তু ডিএনএ পরীক্ষার পর সিআইডির পক্ষ থেকে জানানো হয়, খুনিরা তনুকে ধর্ষণও করেছিল; তার ডিএনএ নমুনা তারা পেয়েছেন।

আলোচিত এই খুনের প্রথম ময়নাতদন্ত নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর আদালতের নির্দেশে ৩০ মার্চ দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্ত করেন কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকরা, যার প্রতিবেদনে ‘সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স’ হওয়ার কথা বলা হয়।

তনু হত‌্যার ঘটনায় দেশজুড়ে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ হলেও এখনও কোনো আসামি ধরা পড়েনি। মীমাংসা হয়নি হত‌্যা মামলার।

নয় মাসেও সোহাগী জাহান তনু হত্যার জট না খোলায় তার হতাশ বাবা-মা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে কথা বলতে চাইছেন।

ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও জট খোলেনি মিতু হত‌্যার

মাহমুদা আক্তার মিতু:
চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের আলোচিত অতিরিক্ত উপ-কমিশনার বাবুল আক্তার ঢাকায় বদলি হওয়ার কয়েক দিনের মধ‌্যে ৫ জুন ভোরে বন্দরনগরীর ওআর নিজাম রোডে সন্তানের সামনে তার স্ত্রী মিতুকে গুলি চালিয়ে ও কুপিয়ে হত‌্যা করা হয়।

ঘটনার পর বাবুল ঢাকা থেকে গিয়ে মামলা করেন এবং দুই সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় এসে শ্বশুর বাড়িতে ওঠেন।

শুরুতে এই হত‌্যাকাণ্ডের জন‌্য জঙ্গিদের সন্দেহ করা হলেও পরে পুলিশের তদন্তের গতিপথ পাল্টায়। এর মধ‌্যে ২৪ জুন রাতে বাবুলকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে নিয়েও সন্দেহের গুঞ্জন সৃষ্টি হয়।

এরপর ৬ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বাবুলের ইচ্ছায় তাকে চাকরি থেকে অব‌্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বাবুল আক্তার বর্তমানে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের কর্মকর্তা।

উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশা খুনের প্রতিবাদে মানববন্ধন হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে।

সুরাইয়া আক্তার রিশা:
ঢাকার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী রিশাকে (১৪) গত ২৪ অগাস্ট স্কুলের সামনের ফুটওভারব্রিজে ছুরি মেরে হত‌্যা করে ওবায়েদ নামের এক যুবক। তিন দিন পর হাসপাতালে মারা যায় রিশা।

ওই ঘটনায় এলিফ‌্যান্ট রোডের বিপণি বিতান ইস্টার্ন মল্লিকার বৈশাখী টেইলার্সের কর্মী ওবায়েদকে আসামি করে মামলা হয়।

ঘটনার পর পালিয়ে যাওয়া ওবায়েদকে পরে নীলফামারীতে গ্রেপ্তারের পর ঢাকায় আনা হয়। আদালতে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন।

দিয়াজের মায়ের দাবি, তার ছেলেকে হত্যার পর লাশ ঘরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।

আত্মহত‌্যা না হত‌্যা?

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার একটি বাসা থেকে গত ২০ নভেম্বর রাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়।

সুরতহাল প্রতিবেদনে দিয়াজের গলায় দাগ ছাড়াও দুই হাতের কনুইয়ের আশপাশে লালচে দাগ এবং বাঁ পায়ে ‘সামান্য আঘাতের চিহ্ন’ থাকার কথা বলা হলেও প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়- ঘটনাটি ‘আত্মহত্যা’।

ওই প্রতিবেদন প্রত‌্যাখ‌্যান করে আদালতে হত‌্যা মামলা দায়ের করেন দিয়াজের মা। তাতে ছাত্রলীগ নেতা টিপু ছাড়াও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ‌্যালয়ের সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন চৌধুরী ও বিশ্ববিদ‌্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপুসহ ১০ জনকে আসামি করা হয়।

এ পরিবারের দাবি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ‌্যালয়ে একটি নির্মাণ কাজের জন‌্য ৯৫ কোটি টাকার টেন্ডার নিয়ে দিয়াজের সঙ্গে বিশ্ববিদ‌্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপুর বিরোধ চলছিল। সেই বিরোধ, চাঁদা দাবিসহ নানা কারণে ‘ষড়যন্ত্র’ করে দিয়াজকে হত্যার পর লাশ ঘরে ঝুলিয়ে রাখা হয়।

দিয়াজের মায়ের আবেদনে আদালত লাশ তুলে পুনঃময়নাতদন্তের নির্দেশ দেয়।

ঢাকা মেডিকেলে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্তের পর ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহকারী অধ‌্যাপক সোহেল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, তারা ‘আঘাতের চিহ্ন’ পেয়েছেন, তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাবেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং ভিসেরা প্রতিবেদন পাওয়ার পর।

ছাত্রলীগ নেতার ধারালো অস্ত্রের আঘাত থেকে প্রায় সুস্থ হয়ে ওঠা সিলেটের কলেজছাত্রী খাদিজা বেগম নার্গিস প্রথমবারের মতো গণমাধ্যমের সামনে আসেন ২৬ নভেম্বর।

মৃত‌্যুঞ্জয়ী খাদিজা

সিলেটের এমসি কলেজে কেন্দ্রে ৩ অক্টোবর বিকালে পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়েই হামলার শিকার হন সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিস। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তার মস্তিষ্কে জখম হয়।

খাদিজাকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক বদরুলের ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানোর ভিডিও ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। বদরুলকে ঘটনাস্থল থেকে ধরে পুলিশে দেয় জনতা।

হামলার পর আহত খাদিজাকে ঢাকায় এনে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কয়েক দফা অস্ত্রোপচারের পর খাদিজা এখন অনেকটা সুস্থ।

বর্তমানে খাদিজাকে সাভারের সিআরপিতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সিলেটে দ্রুত বিচার আদালতে চলছে বদরুলের বিচার। 

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর ধারাবাহিক হামলার প্রতিবাদে রাজধানীর ব্যস্ততম সড়ক শাহবাগ আটকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ।

সাম্প্রদায়িক হামলা, ‘বিচারবহির্ভূত হত‌্যা’

বছরের শুরুতে ১২ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে দিনভর তাণ্ডব চালিয়ে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন ভাংচুর এবং সুর সম্রাটের স্মৃতি বিজড়িত বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র পুড়িয়ে দেয় মাদ্রাসা ছাত্ররা।

এরপর ৩০ অক্টোবর এই ব্রাহ্মণবাড়িয়ারই নাসিরনগরে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে হিন্দুদের বাড়ি-মন্দিরে হামলা হয়। ১৫টি মন্দির ও শতাধিক বাড়িঘরে ভাংচুর-লুটপাট চালানো হয়।

ওই ঘটনার পর সারা দেশে তীব্র সমালোচনার মধ‌্যে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে নাসিরনগর থানার ওসি আব্দুল কাদের এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) চৌধুরী মোয়াজ্জাম আহমদকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। গ্রেপ্তার করা হয় অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে, যাদের মধ্যে স্থানীয় একজন আওয়ামী লীগ নেতাও আছেন।

নাসিরনগরে হিন্দুদের ওপর হামলার প্রতিবাদ চলার মধ্যেই ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল পল্লীতে পুলিশের উচ্ছেদ অভিযান সমালোচনার জন্ম দেয়।

পুলিশের এই গুলি সাঁওতালদের উপর; তাদের বসত ঘরে পুলিশের আগুন দেওয়ার প্রমাণও পরে প্রকাশ পেয়েছে। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে রংপুর চিনিকলের জমি থেকে ৫ নভেম্বর সাঁওতালদের উচ্ছেদের এই তৎপরতা ছিল ব‌্যাপক সমালোচিত।

ওই অভিযানে কয়েকশ ঘর সাঁওতালকে উচ্ছেদের সময় সংঘর্ষ বাঁধে; সাঁওতালদের বাড়িঘরে লুটপাট, ভাংচুরের পর অগ্নিসংযোগ করা হয়। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী গুলি চালায়; নিহত হন দুইজন।

প্রায় এক মাস পর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আসা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন পুলিশ সদস্য সাঁতালদের ঘরে আগুন দিচ্ছেন, যা নিয়ে আদালতের নির্দেশে বর্তমানে তদন্ত চলছে। 

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৮০টি বাড়ি ভাংচুরের শিকার হয়েছে; আহত হয়েছেন ৬৭ জন। ১৫টি মন্দির হামলা ও ভাংচুরের শিকার হয়েছে।

গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালেও র‌্যাব ও পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে বহু মানুষের মৃত‌্যু হয়েছে। আসকের হিসাবে জানুয়ারি-নভেম্বর সময়ে এই সংখ‌্যা ছিল ১৭৩ জন। এছাড়া আরও ৮৮ জনকে ওই সময়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।