বিজয়ের ৪৫ বছর

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দুই যুগের পাকিস্তানি শাসনের অবসান ঘটিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে নতুন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল যে বাংলাদেশ, তা পার করল ৪৫ বছর।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Dec 2016, 05:41 PM
Updated : 16 Dec 2016, 03:43 AM

এই ৪৫ বছরে বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রা যে এখন বিশ্ব দরবারে ‘রোল মডেল’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, তা উঠে এসেছে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বিজয় দিবসের বাণীতে।

গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব‌্যাহত রেখে জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করে বাণী দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

অন‌্যদিকে বাংলাদেশ এখন গণতন্ত্রহীন অবস্থায় নৈরাজ্যের অন্ধকারের মধ‌্যে রয়েছে দাবি করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জাতীয় ঐক্য গড়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

শুক্রবার বিজয়ের ৪৫ বছর পূর্তিতে সরকারি-বেসরকারি নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এই মাটির মুক্তির জন্য প্রাণ দেওয়া ৩০ লাখ শহীদকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে দেশবাসী।

সরকারি-বেসরকারি সব ভবনে উড়ছে জাতীয় পতাকা, সাভার স্মৃতিসৌধসহ দেশের সব শহীদ বেদীগুলো ভরে উঠছে শ্রদ্ধার ফুলে। পথে পথে চলছে বিজয়ের শোভাযাত্রা।

দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও তা যে টিকবে না তা আঁচ করেছিলেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক, তারপর নিপীড়ন-নির্যাতন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বাধিকার এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে প্রবল করে তোলে।

পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বাধিকারের চাওয়াকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ১৯৭১ সালে অস্ত্রের মুখে রুদ্ধ করতে প্রয়াস চালিয়ে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল এই ভূখণ্ডের মানুষের উপর।

বিজয় উদযাপনে রাজধানীতে এই আলোকসজ্জা, যাতে মূর্ত হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযোদ্ধারা

১৯৭৫ সালের ২৫ মার্চ কালরাতের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সেই প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই বাংলার মানুষ। ন‌্যায‌্য অধিকারের সশস্ত্র সেই সংগ্রামে সহায়তার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছিল প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ।

এরপর ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স (এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের যৌথ নেতৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী; লাল সবুজ পতাকা ওড়ে স্বাধীন ভূমিতে, নতুন দেশে।

স্বাধীনতার চার বছরের মধ‌্যে জাতির জনককে হত‌্যার পর বাংলাদেশের উল্টো পথযাত্রায় শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসররা।

চার দশক পর শুরু হওয়া যুদ্ধাপরাধের বিচার চলার মধ‌্যেই আবার বিজয় দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছে দেশ; একে একে ছয়জন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসিকে নতুন বিজয় হিসেবে দেখছেন মুক্তিযোদ্ধারা।

নিয়মিত কর্মসূচির সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল নিষিদ্ধ এবং দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের দাবিও উঠছে এবার।  

বিজয় দিবসের কর্মসূচি শুরু হয় সকালে রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে।

তারপরের কর্মসূচি আবর্তিত হয় সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে। বিজয় দিবসের প্রস্তুতির জন‌্য গত কয়েক দিন ধরে তা বন্ধ রেখে চলছিল ধোয়া-মোছার কাজ।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী সূর্যোদয়ের পরপরই স্বাধীনতার স্মারকে ফুল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

ভিআইপিদের শ্রদ্ধা জানানোর পর স্মৃতিসৌধ সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও ব্যক্তির শ্রদ্ধার ফুলে ভরে ওঠে স্মৃতিসৌধ।

স্মৃতিসৌধের অনুষ্ঠান চলার মধ্যেই সকাল ১০টায় রাজধানীতে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে শুরু হবে কুচকাওয়াজ। এই কুচকাওয়াজের সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন মহড়া চলবে, যার প্রস্তুতি চলছে গত কয়েকদিন ধরে।

রাষ্ট্রপতি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও সালাম নেবেন। প্রধানমন্ত্রীও এ কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন।

বিজয় দিবস উপলক্ষে নৌ-বাহিনীর জাহাজগুলো সর্বসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।

ঢাকার সদরঘাট, নারায়ণগঞ্জের পাগলা নেভাল জেটি, চট্টগ্রামের নিউমুরিং নেভাল জেটি, খুলনার বিআইডব্লিউটিএ রকেট ঘাট, চাঁদপুরে বিআইডব্লিউটি ঘাট, মংলার নেভাল বার্থ এবং বরিশালের বিআইডব্লিউটিএ রকেট ঘাটে দুপুর ২টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জাহাজ পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত থাকবে বলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছে।

বিজয় দিবস উপলক্ষে নানা কর্মসূচি নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন।

বিজয় শোভাযাত্রা, দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে ক্ষমতাসীন দলটি।

বিজয় দিবস উপলক্ষে শোভাযাত্রাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে বিএনপিরও। অন্যান্য রাজনৈতিক দলও বিজয় উদযাপনে আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে।

বিজয় দিবসে কারাগার ও হাসপাতালগুলোতে করা হয়েছে বিশেষ খাবারের ব‌্যবস্থা। বেতার-টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হচ্ছে বিজয়ের অনুষ্ঠানমালা, সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ ক্রোড়পত্র।

বিজয় দিবসের আগে রাজধানীর রাস্তায় ঘুরে ঘুরে জাতীয় পতাকা বিক্রি।

বিজয় দিবসের বাণীতে রাষ্ট্রপ্রধান আবদুল হামিদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।

জাতির জনককে হত‌্যার পর অমসৃণ পথ পেরিয়ে গণতন্ত্র ফিরে আসার উল্লেখ করে আবদুল হামিদ বলেন, “দেশ উন্নতি ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকারের যুগোপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ফলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অর্জিত হচ্ছে নানা সাফল্য। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে ‘রোল মডেল’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।”

স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে আরও অর্থবহ করতে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে দলমত নির্বিশেষে একযোগে কাজ করতে সবার প্রতি আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি।

দেশবাসীকে বিজয়ের শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্ধুর পথ পেরিয়ে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, “আর্থসামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে রোল মডেল। ২০২১ সালের আগেই আমরা বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত, সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করব।

“আসুন, সবাই মিলে একটি সেবামুখী, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি। প্রতিষ্ঠা করি- জাতির পিতার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’।”

বিজয়ের নায়কদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে খালেদা জিয়ার এক বিবৃতিতে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে নিজের উদ্বেগের কথা জানান।

“এদেশে এখন মানুষের নাগরিক স্বাধীনতা নেই। এদেশের মানুষ এখন অধিকার হারা। এদেশে শ্বাশ্বত গণতন্ত্র নিরুদ্দেশ করা হয়েছে। গণতন্ত্রহীন দেশে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার দাপটে সর্বত্র হতাশা, ভয় আর নৈরাজ্যের অন্ধকার নেমে এসেছে। ক্ষমতা জবরদখলকারীরা জনগণের ওপর নৃশংস আক্রমণ চালিয়ে হত্যা করছে।”

এই পরিস্থিতিকে ‘ভয়ঙ্কর নৈরাজ্যময়’ আখ‌্যায়িত করে গণতন্ত্রকে বিপদমুক্ত করতে স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনায় বলীয়ান হতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন খালেদা।