এরা হলেন- যশোরের মণিরামপুর উপজেলার দুর্গাপুর এলাকার নাজিম উদ্দিন (৪২) এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি তৃতীয় বর্ষের ছাত্র শেখ ইফতেশাম আহমেদ শামী (২৩)।
দুই বছর মালয়েশিয়ায় কাটিয়ে গত রোজায় দেশে ফেরা নাজিমকে সাড়ে ছয় মাস আগে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে ঢাকার মিরপুর থেকে ধরে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ পরিবারের।
আর ইফতেশামকে আট মাস আগে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে রাজশাহী নগরীর একটি ছাত্রাবাস থেকে তুলে নেওয়া হয় বলে দাবি স্বজনদের।
বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের কর্নেলহাটে র্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের ছবি টেলিভিশনে দেখে তাদের শনাক্ত করেন স্বজনরা। র্যাব-পুলিশের পক্ষ থেকেও এই দুজনের পরিচয় নিশ্চিত করা হয়েছে।
এর আগে বৃহস্পতিবারই নীলফামারী সরকারি কলেজের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের ছাত্র নূর আলমকে (২২) শনাক্ত করে তার পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, নয় মাস আগে ‘প্রশাসনের লোক পরিচয় দিয়ে’ বাড়ি থেকে তাকে ধরে নেওয়া হয়েছিল।
বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রামের কর্নেল হাট এলাকায় একটি বাড়ি ঘিরে কয়েক ঘণ্টা অভিযান চালানোর পর বোমা তৈরির সরঞ্জামসহ পাঁচজনকে আটকের খবর জানায় র্যাব। আটক ব্যক্তিরা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজিবি) সদস্য এবং তারা নাশকতার পরিকল্পনা করছিল বলে দাবি করা হয় র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে।
শুক্রবার যশোরে নাজিমের বাড়ি গিয়ে চট্টগ্রামে গ্রেপ্তারদের ছবি দেখালে নাজিমকে শনাক্ত করেন তার স্ত্রী নাজমা আক্তার, ছোটভাই আজিমউদ্দিন ও দুই মেয়ে।
তার পরিচয় নিশ্চিত করে যশোরের পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান বলেন, “আমি জেলা পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে খোঁজ নিয়ে জেনেছি চট্টগ্রামে আটক নাজিমই যশোরের মণিরামপুরের নাজিমউদ্দিন।”
যশোরের পাঁচ ব্যক্তি জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত সন্দেহে কিছুদিন আগে পুলিশের প্রকাশ করা পোস্টারে নাজিমের নাম ও ছবি ছিল।
“বন্ধুর বাসায় থাকা অবস্থায় ব্যবসায়িক অংশীদার গাউসুল আজমের ফোন পেয়ে ২৫ মে সকাল ১০টার দিকে বাসা থেকে বের হন নাজিম। গাউসুলের মিরপুরে অফিস করার কথা ছিল, দোকান দেখাতে নাজিমকে ফোন করে সেখানে ডেকে নেন তিনি।
“ওই দিন বেলা ১১টার দিকে মিরপুরে গাউসুলের সামনে থেকে সাদা পোশাকে আসা ডিবি পরিচয়ে চার জন লোক নাজিমকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়।”
এরপর ঢাকায় গিয়ে সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ করে কোনো সন্ধান পেয়ে ২৮ মে পল্লবী ও ভাটারা থানায় মামলা করতে গিয়েছিলেন জানিয়ে নাজমা বলেন, মামলা না নিয়ে ভাটারা থানা পুলিশ একটি জিডি (১৭৩০) গ্রহণ করে।
এরপরে ১ জুন প্রেসক্লাব যশোরে এবং ১৬ জুলাই জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন বলে জানান নাজমা আক্তার। ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কার্যালয়ে স্বামীর ছবিসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে আসার কথাও বলেন তিনি।
নাজিমের বিস্তারিত
মণিরামপুর শহরের দুর্গাপুর এলাকার মৃত হাসান আলী গাজীর বড় ছেলে নাজিম। তার ছোট ভাই আজিম ইজিবাইক চালক।
পরিবারের সদস্যরা জানান, মণিরামপুর সম্মিলনী স্কুল থেকে এসএসসি ও ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশের পর স্থানীয় একটি দুধের কোম্পানিতে চাকরি করতেন নাজিম। এরপর ১৯৯৭ সালে উপজেলার জালঝাড়া গ্রামে বিয়ে করেন। বিয়ের পরে মণিরামপুর কলেজে স্নাতকে ভর্তি হন। ছাত্রজীবনে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেও পরে ছেড়ে দেন।
স্ত্রী নাজমা জানান, বিয়ের পর এক বছর পর্যন্ত তাবলীগ জামায়াত করতেন নাজিম। এরপর মণিরামপুর শহরের ‘নকশা কম্পিউটার’ নামে একটি দোকান দেন। ২০১২ সালের দিকে ওই দোকান বিক্রি করে মালয়েশিয়া যান। দুই বছর পর গত বছরের ২৭ রমজান দেশে ফেরেন।
তারপর ঢাকায় থেকে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার লুচিয়া গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ গাউসুল আজমের (৪০) সঙ্গে সৌদি আরবে নারীকর্মী পাঠাতেন।
গুলশান হামলার পর জঙ্গিবিরোধী তৎপরতার মধ্যে ঈদুল ফিতরের চার দিন পর মণিরামপুর থানা পুলিশ তাদের বাড়িতে যায় বলে জানান নাজমা। ওই সময় তিন দফায় থানায় গিয়ে পুলিশকে তথ্য দেওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি।
“পরদিন সকালে খবর পেয়ে রাজশাহী ছুটে যাই। কোথাও ছেলের সন্ধান না পেয়ে ওই দিনই রাজশাহী নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি নম্বর ১৬১৬) করি।”
পুলিশ তার কোনো সন্ধান দিতে পারেনি বলে জানান তিনি।
বোয়ালিয়া মডেল থানার ওসি শাহাদৎ হোসেন জিডি দায়েরের বিষয়টি নিশ্চিত করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, “ইফতেশামের সন্ধান অব্যাহত রাখার মধ্যেই বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে জঙ্গি আস্তানায় আটক পাঁচজনের মধ্যে তার ছবি টেলিভিশনে দেখতে পাই।”
বৃহস্পতিবার অভিযানের পর র্যাবের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শাহী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
শামী ও নাজিমকে আগেই আটকের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটি একান্ত পরিবারের বক্তব্য। আমরা আমাদের অফিসিয়াল বক্তব্য কালই দিয়েছি। নাশকতার জন্য তাদের গ্রেপ্তার করেছি। এছাড়া তাদের কাছে সব কিছু পাওয়া গেছে।”
ঢাকা থেকে সম্প্রতি আরও পাঁচ-ছয় জনের নিখোঁজ হওয়ার খবরের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, “তাদের স্বজনরাও তো বলবে যে, তারা জিডি করেছিল। এরা আসলে পরিবারকে কিছু না বলেই চলে যায়।”