যুদ্ধাপরাধ: শরীয়তপুরের ইদ্রিস আলীর রায় সোমবার

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ মামলায় শরীয়তপুরের মৌলভী ইদ্রিস আলী সরদারের সাজা হবে কি না, তা জানা যাবে সোমবার।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Dec 2016, 05:55 AM
Updated : 5 Dec 2016, 04:49 AM

একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় শরীয়তপুর ও মাদারীপুর এলাকায় গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন, লুটপাট-অগ্নিসংযোগ ও হিন্দুদের দেশান্তরে বাধ্য করার মত মানবতাবিরোধী অপরাধের চার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে এই পলাতক আসামির বিরুদ্ধে।

বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সোমবার সকালে এ মামলার রায় ঘোষণা করবে।

ট্রাইব‌্যুনালের প্রসিকিউটর জিয়াদ আল মালুম জানান, রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা মামলাটি রোববার কার্যতালিকায় এলে বিচারক রায় ঘোষণার দিন ঠিক করে দেন।

এর আগে প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে গত ২ নভেম্বর মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়।

এ মামলায় গ্রেপ্তার অপর আসামি মাওলানা সোলায়মান মোল্যা ওরফে সোলায়মান মৌলভী গত ২৫ অক্টোবর ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

চলতি বছর ২ মে যুদ্ধাপরাধের চার ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ইদ্রিস ও সোলায়মানের বিচার শুরু করেছিল ট্রাইব্যুনাল।

২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরুর পর এটি ২৭তম মামলা, যেটি রায়ের পর্যায়ে এসেছে।

এ মামলায় প্রসিকিউশনের পক্ষে প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুমের সঙ্গে ঋষিকেশ সাহা ও রেজিয়া সুলতানা চমন শুনানিতে অংশ নেন। আর পলাতক আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হিসাবে শুনানি করেন গাজী এমএইচ তামিম।

রেজিয়া সুলতানা চমন জানান, যুক্তিতর্কে তারা আসামি ইদ্রিস আলীর সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছেন।

ইদ্রিস আলী সরদার

শরীয়তপুর সদর উপজেলার চিতলিয়া ইউনিয়নের পালং থানার পশ্চিম কাশাভোগ গ্রামের ইদ্রিস আলী সরদার স্থানীয় রুদ্রকর নিনমনি হাই স্কুল থেকে ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাস করেন। ওই স্কুলে পড়ার সময়ই তিনি জামায়াতে ইসলামীর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সঙ্গে যুক্ত হন।

প্রসিকিউশনের তদন্ত সংস্থার তথ‌্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইদ্রিস ছাত্র সংঘের স্থানীয় নেতায় পরিণত হন। ছাত্রসংঘের অন‌্য অনেক নেতাকর্মীর মত তিনিও পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় গড়ে তোলা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন এবং যুদ্ধাপরাধে অংশ নেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তিনি জামায়াতের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন বলে তদন্ত সংস্থার ভাষ্য।

সোলায়মান মোল্যা

পালং থানার কাশিপুর গ্রামের সোলায়মান মোল্যার জন্ম ১৯৩১ সালে। ১৯৬৩ সালে তিনি দাওরা পাস করে মুসলিম লীগে (ফজলুল কাদের) এ যোগ দেন। পরে তাকে পালং থানা মুসলিম লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকও করা হয়।

অভিযোগপত্রের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭০ এর নির্বাচনে জামিয়াতুল উলামায় ই-ইসলামীতে যোগ দিয়ে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন সোলায়মান।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি নিজের এলাকায় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠনে নেতৃত্ব দেন এবং পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেন বলে প্রসিকিউশনের অভিযোগ।

শরীয়তপুর সদর উপজেলার স্বর্ণঘোষ গ্রামের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদ তালুকদার ২০১০ সালের ১১ মে ইদ্রিস আলী ও সোলায়মান মোল্যাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে শরীয়তপুরের আদালতে মামলা করেন। ওই মামলা পরে পাঠানো হয় ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

তদন্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল অনুসন্ধান শেষে ইদ্রিস ও সোলায়মানের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। গতবছর ২২ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নিয়ে চলতি বছর মে মাসে অভিযোগ গঠন করে।

এ মামলায় প্রসিকিউশনের পক্ষে মোট ১৩ জনের সাক্ষ্য শুনেছে আদালত।

অভিযোগ ১: ১৯৭১ সালের ২২ মে বেলা আনুমানিক ৩টার দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সোলায়মান মোল্যা ও ইদ্রিস আলীসহ রাজাকার বাহিনীর সদস‌্যদের নিয়ে কাশাভোগ বাজারে যায়। দুই আসামির উস্কানিতে এক সেনা কৃষক আব্দুস সামাদ শিকদারের ওপর গুলি চালায়। তার মৃত্যু হলে আসামিরা সামাদ শিকদারের বাড়িতে লুটপাট চালায়।

পরে তারা সম্ভু নাথ কর্মকার নামের এক কামারকে গুলি করে হত্যা করে এবং হিন্দু অধ্যুষিত মধ্যপাড়া গ্রামে হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। ওইদিন এই দুই রাজাকার সদস‌্যের নেতৃত্বে ওই বাহিনী গ্রামের প্রায় দুইশ লোককে হত্যা করা হয়।

এসব ঘটনায় সোলায়মান মোল্যা ও ইদ্রিস আলীর বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মত মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকা ও সহায়তার অভিযোগ আনা হয়েছে।

অভিযোগ ২: ১৯৭১ সালের ২৩ মে ইদ্রিস আলী ও সোলায়মান মোল্যাসহ রাজাকার বাহিনীর আরও কিছু সদস‌্যকে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আঙ্গারি বাজারের কাছে লঞ্চঘাট এলাকায় যায় এবং আবুল কালাম হাওলাদার নামের এক ব‌্যক্তিকে ধরে নির্যাতন করে।

পরে তারা পালং থানাধীন হিন্দু অধ্যুষিত মালোপাড়ায় (জেলে গ্রাম) হামলা চালায়। সেখানে ১৫/২০ জন পুরুষ ও ১৪/১৫ জন নারীকে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন করা হয়; বাড়িঘরে ভাংচুর চালিয়ে লাগানো হয় আগুন।

পরে দুই আসামি ও তাদের সহযোগীরা পাশের রুদ্রকর গ্রামে হামলা চালায়। সেখানে জলিলুর রহমান নামে এক ব্যক্তিকে নির্যাতন করে বেঁধে সাবেক জমিদার প্রেমনাথ চক্রবর্তীর বাড়িতে যায়। সেখানে একটি মন্দির ভাঙা হয় এবং চন্দ্র মোহন চক্রবর্তী নামের একজন পুরোহিতকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

গ্রাম থেকে আটক ব্যক্তিদের হাওলাদার জুট মিলের অস্থায়ী সেনাক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করে আসামী ও তাদের রাজাকার সহযোগীরা। সেখানে পুরুষদেরকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং বিভিন্ন বয়সী নারীদের তিনদিন আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়।

এসব ঘটনায় দুই আসামির বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।

অভিযোগ ৩: একাত্তরে জুন মাসের মাঝামাঝি কোনো এক দিনে দুই আসামিসহ আরও কিছু রাজাকার সদস‌্য ও পাকিস্তানি সেনা মাদারীপুরে আওয়ামী লীগ নেতা শীলেন্দ্র কৃষ্ণ পালের বাড়িতে (এখন ডিসির বাংলো) আক্রমণ করে। তাকে না পেয়ে ওই বাড়ির চারজন পাহারাদারকে নির্যাতনের পর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়; বাড়িতে চালানো হয় ভাঙচুর।

এ ঘটনায় দুই আসামির বিরুদ্ধে আনা হয়েছে হত্যা ও আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ।

অভিযোগ ৪: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ইদ্রিস আলী ও সোলায়মান মোল্যাসহ রাজাকার সদস‌্যরা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে মাদারীপুরের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকহারে হিন্দুদের ওপর পরিকল্পিত দমন-পীড়ন ও হত্যাকাণ্ড চালায়। ধর্ষণ, নির্যাতন, হত্যা ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডের মাধ‌্যমে ত্রাস সৃষ্টি করে তারা বহু হিন্দুকে নিজের ভূমি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে।

এ ঘটনায় দুই আসামির বিরুদ্ধে হিন্দুদের দেশত্যাগে বাধ্য করার অভিযোগ আনা হয়েছে।