‘তবে’ রেখেই হচ্ছে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন

বিয়ের জন্য আগের মতই মেয়েদের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১৮ বছর এবং ছেলেদের ২১ বছর বয়স হওয়ার শর্ত রেখে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’ করার প্রস্তাবে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে সরকার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Nov 2016, 09:37 AM
Updated : 24 Nov 2016, 12:44 PM

তবে ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ আদালতের নির্দেশনা নিয়ে এবং বাবা-মায়ের সমর্থনে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদেরও বিয়ের সুযোগ রাখা হচ্ছে এই আইনে।

‘কোনোভাবেই’ মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স না কমানোর দাবির মধ‌্যেই বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন- ২০১৬’ এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।

সভা শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেন, ১৯২৯ সালের চাইল্ড মেরিজ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টকে পুনর্বিন্যাস্ত করে আইনটিকে বাংলায় করা হয়েছে।

“এখানে (নারীদের) বিয়ের বয়স ১৮-ই আছে। তবে একটা বিশেষ বিধান রাখা হয়েছে।”

বিশেষ বিধান

“এই আইনের অন্যান্য বিধানে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো নারীর সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশনাক্রমে এবং মাতা-পিতার সম্মতিক্রমে বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণক্রমে বিবাহ সম্পাদিত হইলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে না।”

‘বিশেষ কেইসের’ জন্য এই বিধান রাখা হয়েছে জানিয়ে শফিউল বলেন, ১৮ বছরের নিচে বিয়ে হলে তা অপরাধ; তবে ‘বিশেষ কেইসের’ ক্ষেত্রে তা হবে না।

এর ব‌্যাখ‌্যায় মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, “অবিবাহিত মাতা, কিন্তু তার বাচ্চা আছে- এ রকম কেইস যদি হয়, এসব ক্ষেত্রে তাকে প্রোটেকশন দেওয়ার জন্য এই বিধান করা হয়েছে।… কত ধরনের সমস্য দেখা দেয়.. এজন্য বিয়েগুলো হয়ে যায়। ওটাকে লিগালাইজ করার জন্য এই প্রক্রিয়া।”

তবে আইনে ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটের’ কোনো সংজ্ঞা রাখা হয়নি বলে জানান শফিউল।

তিনি বলেন, এটা আদালত নির্ধারণ করবে। বিশেষ প্রেক্ষাপটের ক্ষেত্রে কোনো বয়সও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি।

“আমাদের দেশে তো ১০-১১ বছরেও পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে প্রেগন‌্যান্ট হয়ে যায়। এ সমস্যাগুলো আছে তো, এটার জন্য একটা ব্যবস্থা।”

নতুন আইনের খসড়ায় ‘অপ্রাপ্তবয়স্কের’ সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “বিবাহের জন্য ২১ বছর পূর্ণ করেননি এমন কোনো পুরুষ এবং ১৮ বছর পূর্ণ করেননি এমন কোনো নারী।”

নতুন আইনে সাজা

# আলাদত নিজ উদ্যোগে অথবা কারও অভিযোগের ভিত্তিতে বিয়েতে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারবে এবং সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে পারবে।

#ওই নিষেধাজ্ঞা না মানলে ছয় মাসের জেল, ১০ হাজার টাকা জরিমান বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে।

# মিথ্যা অভিযোগ করলে সর্বোচ্চ ছয় মাস কারাদণ্ড, কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে।

# অপ্রাপ্তবয়স্করা বিয়ে করলে আইন অনুযায়ী তাদের সর্বোচ্চ ১৫ দিনের আটকাদেশ বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে।

# প্রাপ্তবয়স্ক কানো নারী বা পুরুষ বিয়ের বয়স হয়নি এমন কাউকে বিয়ে করলে অনধিক দুই বছর কারাদণ্ড, এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

# বাল্যবিয়ের সঙ্গে পিতা-মাতা বা অন্যরা জড়িত থাকলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। জরিমানার টানা না দিলে আরও তিন মাসের জেল খাটতে হবে।

# বাল্যবিয়ে সম্পাদন বা পারিচালনা করলেও ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে।

# বাল্যবিয়ে নিবন্ধন করলে নিবন্ধকের লাইসেন্স বাতিল হবে। পাশাপাশি ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব সাংবাদিকদের জানান, ‘বাল্যবিবাহ বন্ধে উদ্যোগী হইবার শর্তে’ বাল্যবিয়ের অভিযোগ থেকে অব্যাহিত পাওয়ার একটি সুযোগ আইনের খসড়ায় রাখা হয়েছে।

তবে ওই সুযোগ নিয়ে এর বেশি তথ‌্য বা কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেননি।

শফিউল বলেন, বয়স প্রমাণে জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, পঞ্চম ও অষ্টমের সমাপনী, এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষার সনদ ও পাসপোর্ট আইনগত দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে।

যে অর্থদণ্ড আদায় হবে তা ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে পরিশোধ করা যাবে।

অন্যান্য ফৌজদারি বিচার যেভাবে হয়, সরেজমিনে তদন্ত করে সেভাবেই বাল‌্যবিয়ের অভিযোগের বিচার হবে। এ আইনের আওতায় ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করা যাবে।

বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে এই রকম প্রচার চালাচ্ছে বিভিন্ন সংগঠন

বিরোধিতা

ব্র্যাকের এক গবেষণার তথ‌্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার ৬৫ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ এবং পৃথিবীতে চতুর্থ। বাংলাদেশে প্রতি তিনটি বিয়ের দুটিতেই কনের বয়স থাকে ১৮ বছরের নিচে। বাল্যবিয়ের ৮০ শতাংশই ঘটে দরিদ্র্য পরিবারে।

মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর থেকে কমানো যায় কি না- তা নিয়ে ২০১৩ সালে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে প্রথম আলোচনা উঠলে বিভিন্ন মহল থেকে এর বিরোধিতা করা হয়।

তারপরও গতবছর মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি আইনের খসড়া তৈরি করে, যাতে ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৬ বছর করার প্রস্তাব করা হয়।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি সে সময় ‘বিশেষ পরিস্থিতির’ ব্যাখ্যায় বলেন, “মেয়ে প্রেমঘটিত কারণে ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেলে বা মেয়ে ছেলের বাড়িতে চলে যাওয়ার পর নিজের বাড়িতে ফিরে আসতে অস্বীকৃতি জানালে বা বিয়ের আগে গর্ভবতী হলে- এরকম পরিস্থিতিতে ১৬ বছর করা যায় কি না, তা সরকার চিন্তা-ভাবনা করছে।”

এ নিয়ে সিদ্ধান্তে আসার আগে চলতি বছর এপ্রিলে মাতৃমৃত্যু রোধ ও বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় ক্ষমতাসীন দলের দুই সংসদ সদস্যও বিয়ের বয়স কমানোর প্রস্তাবে তাদের আপত্তির কথা তুলে ধরে বলেছিলেন, কোনো ধরনের শর্ত রেখেও মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ এর নিচে আনা উচিৎ হবে না।

আর গতবছর জুনে এক অনুষ্ঠানে মানবাধিকার কমিশনের তখনকার চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান সরকারকে সতর্ক করে বলেছিলেন, মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানো হলে তা ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে উৎসাহিত করবে।

সম্প্রতি সেইভ দ‌্য চিলড্রেনের এক প্রতিবেদনে মেয়ে শিশুদের সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাল‌্যবিয়েকে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

মেয়েদের বেড়ে ওঠার, বিকশিত হওয়ার সুযোগ বিচার করে সেইভ দ‌্য চিলড্রেন অক্টোবরে বিশ্বের ১৪৪ দেশের যে একটি সারণী প্রকাশ করে, যাতে বাংলাদেশের অবস্থান দেখানো হয় ১১১ নম্বরে।

আন্তর্জাতিক এ সংস্থার সিইও ক‌্যারোলিন মাইলস সে সময় নিউজ উইককে বলেছিলেন, “কিছুদিন আগেই আমি বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। সেখানে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই এক তৃতীয়াংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। অনেক দেশেই এটাকে সামাজিক সংস্কৃতির অংশ হিসেবে দেখা হয়, সরকারি নীতির অংশ হিসেবে নয়; এটা আমাকে দারুণ পীড়িত করে।”