দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক শনিবার ঢাকায় এক গোলটেবিল বৈঠকে বলেন, কৌশলগত কারণে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে রাখা হয়েছে।
“আমি দেশের বাইরেও বলেছি, এখনও বলছি, আমি কোনো দিনও বিশ্বাস করি না বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকা উচিত। এটা আমাদের কৌশল। আমরা সুযোগ পেলেই, সময় পেলেই ইনশাআল্লাহ এটা তুলে দেব।
“আমি ব্যক্তিগতভাবে দলের পক্ষ থেকে বলছি- এটা আমরা কোনো দিনও বিশ্বাস করি না।”
জাতীয় প্রেস ক্লাবে সার্ক কালচারাল সোসাইটি আয়োজিত ওই আলোচনায় বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য তুলে ধরার এক পর্যায়ে একথা বলেন ক্ষমতাসীন দলের এই নেতা।
সব ধর্মের মানুষের সম্মিলিত সংগ্রামে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছিল ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’।
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের উল্টোযাত্রায় ক্ষমতা নিয়ে জিয়াউর রহমান ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ দিয়ে সেখানে ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা’ স্থাপন করেন।
এরপর আরেক সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ অষ্টম সংশোধনী এনে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যোগ করেন।
নিজের জীবনাচরণে ইসলামের কোনো প্রতিফলন না থাকলেও শুধু রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত।
এরশাদের পতন ঘটানোর পর রাষ্ট্রধর্মের বিধান বাদ দেওয়ার দাবি বিভিন্ন সময়ে উঠলেও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বাদানকারী দল আওয়ামী লীগও এতে হাত দেয়নি।
২০১১ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংশোধনীতে দলটি ’৭২ এর চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা হলেও ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ আগের মতোই থেকে যায়।
সংবিধানে একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম রাখার বৈপরিত্যের সমালোচনার মধ্যেই আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতার মুখে তা পরিবর্তনের কথা এল।
গোলটেবিল আলোচনার প্রধান অতিথি রাজ্জাক বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরে বলেন, “অসাম্প্রদায়িকতার শক্তি বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে রয়েছে। আমাদের দেশে সংখ্যালঘু বলতে কিছু নেই।”
নাসিরনগরে হিন্দুদের উপর হামলার প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত ‘সন্ত্রাসবাদের প্রতিরোধে প্রয়োজন বাংলাদেশ ও ভারতের গণ-মানুষের সুদৃঢ় ঐক্য’ শীর্ষক এই গোলটেবিলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকরা অংশ নেন।
এর মধ্যে ছিলেন সর্ব ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য প্রীতম ঘোষ, সাবেক বিধায়ক অজয় দত্ত, বিজেপির অন্যতম মুখ্যপাত্র শিলাদিত্য দেব।
কংগ্রেস নেতা প্রীতম ঘোষ সাম্প্রদায়িকতাকে ক্ষমতায় টিকে থাকার ‘রাজনৈতিক চাল’ হিসেবে দেখিয়ে বলেন, “ধর্ম নয়, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মূলে রয়েছে ক্ষমতা ও টাকা। ক্ষমতার লিপ্সা থেকেই সাম্প্রদায়িকতার জন্ম। যারা দাঙ্গা করছেন তারা হিন্দু কিংবা মুসলিম নয়।”
জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পদক্ষেপের প্রশংসা করেন পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত অজয় দত্ত।
“বাংলাদেশে এসে আমার চোখ খুলে গেছে। আমি ভারত যেয়ে বলব বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমানরা একত্রিত হয়ে সন্ত্রাসবাদের প্রতিবাদ জানাচ্ছে।”
মুক্তিযুদ্ধের সময় দোভাষীর কাজ করা সাবেক এই বিধায়ক শুধু নাসিরনগরের ঘটনা দিয়ে বাংলাদেশকে বিচার করতে চান না।
“কোথায় বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা? সাংবাদিকরা তো কিছু লুকিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছেন না, সংবাদপত্রের সাংবাদিক ও সম্পাদকরাও তো মুসলমান। বরং এই দেশে প্রতিবাদ, মিছিল, মানববন্ধন ও সম্মেলন হচ্ছে হিন্দুদের উপর হামলার প্রতিবাদে।”
বিজেপি নেতা শিলাদিত্য দেব বাংলাদেশকে ভারতের ‘ভাতৃসম’ অভিহিত করে বলেন, “ভাই ভাইয়ে সম্পত্তির বিভাজন হলেও রক্ত একই থাকে, তেমনি আমাদের সম্পত্তির বিভাজন হয়েছে, কিন্তু তাতে তো আর রক্তের টান চলে যেতে পারে না। ধর্ম আলাদা হলেও আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভাষা ও কৃষ্টি এক ও অভিন্ন।”