জেলখানায় মুহিতের ৪২ দিন

পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন সড়কের কারাগারটি চলে গেছে কেরানীগঞ্জে, কিন্তু এই কারাগার ঘিরে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের স্মৃতি রয়ে গেছে।

কামাল তালুকদার নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Nov 2016, 05:45 PM
Updated : 1 Nov 2016, 07:17 PM

পরিত‌্যক্ত সেই কারাগারে মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রায় বিস্মৃত সেই স্মৃতি শোনান বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

৮০ পেরুনো এই মন্ত্রী ছাত্রজীবনের সেই স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে শুনিয়েছেন সবাইকে, মাঝে মাঝে কিছু ঘটনা তাকে মনেও করিয়ে দিতে হয়েছে অতিথিদের।

জেল হত‌্যা দিবসের অনুষ্ঠানে নিজের কারাস্মৃতি বলা শুরু করলেও তা কখনকার তা বলে শুরু করেননি মুহিত। তবে পরে তার কথায় স্পষ্ট হয় সময়টি ছিল ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারির।

এখনকার আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী মুহিত তখন ঢাকা বিশ্ববিদ‌্যালয়ে পড়তেন, তখন তার সম্পৃক্ততা ছিল তখন বাম ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে।

ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে পরিত্যক্ত কারাগারে মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার দুর্লভ আলোকচিত্র নিয়ে প্রদর্শনী ঘুরে দেখেন অতিথিরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দিলে ১৯৫৫ সালে বাংলার ছাত্র-জনতা যে বিক্ষোভ দেখায়, তাতে সম্পৃক্ত হয়েই কারাগারে যেতে হয়েছিল মুহিতকে।

৬০ বছর আগের স্মৃতি বলতে গিয়ে মুহিত শুরু করেন এভাবে- “৪২ দিন এই জেলে ছিলাম, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত যে ভবনে ছিলাম সেই ভবন আর নাই।” 

ইংরেজিতে ডিগ্রি নিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৬০ সালে একবার নাজিমউদ্দিন সড়কের ওই কারাগারের স্মৃতিচিহ্ন খুঁজতে গিয়েছিলেন মুহিত। কিন্তু ততদিনে বদলে গেছে তার কারাজীবনের সেই ওয়ার্ড। তা ভেঙে গড়া হয় উঁচু দালান।

মুহিত বলেন, “যেই ওয়ার্ডে আমি ছিলাম সেই ওয়ার্ডের নাম ছিল খুব ইন্টারেস্টিং- মেনটাল ওয়ার্ড। মানে হল বিকারগ্রস্ত লোকজনের সেখানে থাকার ব্যবস্থা।”

নাম ‘মেনটাল ওয়ার্ড’ হলেও মুহিত যখন কারাগারে ঢোকেন, তখন স্বাভাবিক বন্দিদেরও ওই ওয়ার্ডে রাখা হত।

ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে পরিত্যক্ত কারাগারে মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার দুর্লভ আলোকচিত্র নিয়ে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ১১ দিন আগে মুহিতসহ আটজনকে বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে লালবাগ থানায় নেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে পাঠানো হয় কারাগারে।

তখনকার সলিমুল্লাহ হলে ছাত্র মাহবুব আনাম, আব্দুল আউয়াল, ফজলুল হক হলের ছাত্র মনসুর আলী (জাতীয় চার নেতার একজন), ফজলুল হক (বর্তমানে কোথায় আছেন তা মনে নেই মুহিতের), ঝালকাঠীর নিরোধ নাথ (বর্তমানে প্রয়াত), মোমেন তালুকদারের (প্রতিমন্ত্রী ছিলেন) নাম মনে করতে পারেন মুহিত।

“সারাদিন থানায় থাকার পর বিকালে আমাদের জেলগেটে আনা হয় এবং জেলগেটে এসে দেখি আরও কয়েকজন রয়েছে। তাদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের শামসুজ্জোহা, যার ছেলে আমাদের শামীম ওসমান, আরেকজন ছিলেন নারায়ণগঞ্জের একজন শ্রমিক নেতা জামিল।”

“জেলখানায় মেনটাল ওয়ার্ডে ঢুকানো হল এবং বলা হল- ‘১২টি কামরা আছে, আপনাদের ইচ্ছা করলে সবাই আলাদা আলাদা থাকতে পারবেন। তবে একসাথে থাকলে হলে দুজন থাকা যাবে না, তিনজন থাকতে হবে এক সাথে।”

ওই ওয়ার্ডে ১১ দিন ছিলেন তারা। দ্বাদশ দিনে ২১ ফেব্রুয়ারি প্রায় ৫০০ ছাত্র-ছাত্রীকে কারাগারে নেওয়া হলে ওই ওয়ার্ড থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় মুহিতদের।

.

এরপর অন‌্য ওয়ার্ডে ৩০ দিন থাকেন মুহিত।

“এর মধ্যে অনেক কিছু ঘটে যায়। সেখানে মোটামুটি আনন্দময় আসর ছিল। তবে সে আনন্দের মধ্যেও অনেক রকম বিপদ আসত।”

সরকার তখন মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দিতে ব‌্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছিল বলে মুহিত জানান।  

“এক শর্তে একটি চুক্তিনামায় সই করবে যে আমি আর কোনোদিন এ রকম রাজনীতি করব না। কিছু কিছু ছেলে এই চুক্তিনামা সই করল এবং আস্তে আস্তে চলে যেতে থাকল।”

“আমাদের সঙ্গে ১৪টি বালক ছিল। তারা স্কুলের ছাত্র ছিল। এই ১৪টি বালক খোঁজ নিয়ে জানলো যে এই বেটারা সব চুক্তি করে বের হয়ে যায়। তখন তারা নিজেরাই একটি আয়োজন করল যে যখনই এরকম কেউ চুক্তি করে বের হয়ে যায়, তখন তারা ছোট্ট করে একটা আওয়াজ তোলে ‘ঠুস, ঠুস’। তারপর এই আওয়াজটা সবাই নিয়ে নেয়। আড়াইশ-তিনশ মানুষ চিৎকার করে বলছে ‘ঠুস’।”

ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে পরিত্যক্ত কারাগারে মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার দুর্লভ আলোকচিত্র নিয়ে প্রদর্শনীতে দর্শনার্থী। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

এই কারণে মুচলেকা দিয়ে বের হওয়ার প্রবণতা কমে গিয়েছিল বলে জানান মুহিত।

“কিছুদিনের মধ্যে এটা আর হয় না। কেউ চুক্তি করে বের হচ্ছে না। কেউ ঠুসের মুখোমুখি হতে চায় না। তখন জেল কর্তৃপক্ষ আরেকটা উপায় বের করল। যাদের একটু দুর্বলতা (চুক্তি করে বের হওয়ার) আছে। জেল কর্তৃপক্ষ তাদের অসুস্থ দেখিয়ে জেল হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং সেখানে চুক্তি করে বের করে দেন।”

“বিষয়টি বুঝতে পেরে আমরা হাসপাতালে গিয়ে সেই ঠুস শোনানোর চিন্তাভাবনা করলাম এবং আমিসহ অনেকে অসুস্থ হওয়ার ভান করলাম।”

১৩ আনার খাবার

মুহিত জানান, তখন বন্দি হিসেবে তাদের প্রত্যেকের জন্য প্রতিদিন সোয়া ১৩ আনা (১৬ আনায় এক টাকা) বরাদ্দ ছিল। সেই পয়সা দিয়ে রাতে ও দুপুরের খাবার পাওয়া যেত, সকালের চায়ের সঙ্গে মুড়ি এবং বিকালে শুধু চা দেওয়া হত।

.

“জেল কর্তৃপক্ষ বলত, একদিন কষ্ট করে পয়সা বাঁচিয়ে অন্য দিন ভালো খাবার পেতে পারেন। এইভাবে চলত আমাদের। আমরা ডাইনিং কমিটি করে কোনদিন কী খাবার খাব, তার তালিকা করতাম।”

“সব খাবারে একটি একই রকম গন্ধ অথবা সুবাতাস যাই বলেন, পাওয়া যেত। তাহল ওষুধের গন্ধ। পরে বুঝতে পারলাম। কর্তৃপক্ষ ন‌্যাপথলিন দিয়ে সবকিছু ধোয়ার কাজ করত বলে ওষুধের গন্ধ পেতাম।”

কল্পনায় নিউ মার্কেট ভ্রমণ

চার দেয়ালের বন্দি জীবনের মধ‌্যে কীভাবে কল্পনায় নিউ মার্কেটে যেতেন, তাও বলেন মুহিত।   

“বন্দি হয়ে থাকা এটা ছিল দুঃখের বিষয় এবং এটাই সবাইকে কুঁড়ে কুঁড়ে মারত। আমি নিজের একটি ব্যবস্থা করেছিলাম। প্রতিদিন সাড়ে ৩টা কি ৪টার দিকে ঘুম দিয়ে উঠে কাপড় পরে বলতাম- আমি একটু নিউ মার্কেট চললাম।”

“আমার সাথে আরও কিছু সাপোর্টার পেতাম এবং সাড়ে ৩টা-৪টার দিকে নিউ মার্কেট যেতাম। ‘ইমাজিনেশন’ আর কি একটু হাঁটাহাঁটি করলাম আর কল্পনায় যেতাম আর কী।”

বন্দি অবস্থায় ভলিবল, ফুটবল খেলতেন বলে জানান মুহিত।

ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে পরিত্যক্ত কারাগারে মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার দুর্লভ আলোকচিত্র নিয়ে প্রদর্শনীর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল (বাঁ থেকে তৃতীয় ও চতুর্থ)। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

জেল হত্যা দিবস উপলক্ষে পাঁচ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনের পরপরই কারাস্মৃতি তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী।

পরিত‌্যক্ত এ কারাগারের অভ্যন্তরে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। ‘সংগ্রামী জীবনগাথা’ শিরোনামে এই প্রদর্শনীতে বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতার দুর্লভ আলোকচিত্র রয়েছে। ১০০ টাকার টিকেট কেটে যে কেউ প্রদর্শনীতে ঢুকতে পারবেন।

অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ছিলেন। অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আজকে যে স্থানে আমি দাঁড়িয়ে আছি, তা সুদীর্ঘ ২২৮ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী।”

জেলখানায় হত‌্যাকাণ্ডের শিকার এ এইচ এম কামরুজ্জামানের ছেলে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, স্থানীয় সংসদ সদস‌্য হাজি মো. সেলিমও অনুষ্ঠানে ছিলেন।