‘দ্বৈত শাসনের’ অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন চান প্রধান বিচারপতি

অধস্তন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি, বদলির ক্ষমতা এককভাবে সুপ্রিম কোর্টের হাতে না থাকায় ‘দ্বৈত শাসন’ সৃষ্টি হচ্ছে জানিয়ে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বাতিল করে ১৯৭২ এর সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ ফেরাতে বলেছেন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Oct 2016, 11:32 AM
Updated : 31 Oct 2016, 11:32 AM

বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের নয় বছর পূর্তি উপলক্ষে সোমবার এক বাণীতে প্রধান বিচারপতি এই মত দেন।

বাণীতে তিনি বলেন, সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে অধস্তন সকল আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ওপর হাই কোর্টের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ থাকবে বলা হয়েছে। কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদে যে বিধান দেওয়া হয়েছে তা বিচার বিভাগরে ধীরগতির অন্যতম কারণ।

“এই অনুচ্ছেদ অনুসারে অধস্তন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি, বদলি এবং শৃঙ্খলামূলক কার্যক্রম সুপ্রিম কোর্টের পক্ষে এককভাবে গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। দ্বৈত শাসনের ফলে বহু জেলায় শূন্য পদে সময়মত বিচারক নিয়োগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে বিচার কাজে বিঘ্ন ঘটে এবং বিচারপ্রার্থী জনগণের ভোগান্তি বেড়ে যায়।”

এই প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদটি পুনঃপ্রবর্তন করা ‘সময়ের দাবি’ বলে মনে করেন প্রধান বিচারপতি।

“সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্বপালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান সুপ্রিম কোর্টের উপর ন্যস্ত থাকবে। উক্ত বিধানটি পুনঃপ্রবর্তন করলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আরও সমুন্নত ও সংহত হবে এবং বিচার বিভাগের সার্বিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ হবে।”

বাংলাদেশের সংবিধান

বর্তমান সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা প্রযুক্ত হবে।

সংবিধানে প্রদত্ত এই ক্ষমতায় সরকারের আইন মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রপতির পক্ষে এসব কাজ করে থাকে।

আর ১৯৭২ সালের সংবিধানের এই ধারায় বলা ছিল, বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকবে।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মা‌ধ‌্যমে ৭২ এর সংবিধানের চার মূলনীতি ফিরিয়ে আনে। কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদে বাহাত্তরের বিধান আর ফেরেনি।

বাণীতে প্রধান বিচারপতি বলেন, স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার এবং বাঙালি জাতির স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি ‘অনন্য সংবিধান’ পেয়েছে।

“আমাদের মূল সংবিধানে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের বিষয়টি স্পষ্ট থাকালেও প্রকৃতপক্ষে পৃথকীকরণের জন্য অতীতে আন্তরিকভাবে উদ্যোগ গৃহিত হয়নি। বরং সামরিক সরকারের অবৈধ হস্তক্ষেপে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিভিন্ন সময় লঙ্ঘিত হয়েছে।”

বিচারপতি সিনহা বলেছেন, আদালতের রায়ের ভিত্তিতে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আলাদা হওয়ার পর অবকাঠামোগত ও নানা প্রতিকূলতার মধ‌্যেও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের দায়িত্ব পালনের মধ‌্য দিয়ে ‘দ্রুত ও গুণগত বিচার নিষ্পত্তি নিশ্চিত’ হয় এবং তাতে বিচার বিভাগের ওপর জনগণের আস্থা ‘ক্রমশ বাড়তে থাকে’।

“কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, নয় বছরেও ম্যাজিস্ট্রেসির জন্য পূর্ণাঙ্গ অবকাঠামোগত স্থাপনা নির্মিত হয়নি। ১৭০ জন বিচারককে এজলাস ভাগাভাগি করে বিচার কাজ করতে হচ্ছে। এতে বিচারিক কর্মঘণ্টার পূর্ণ ব্যবহার করা যাচ্ছে না। যা মামলা নিষ্পত্তিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে “

প্রধান বিচারপতি জানান, ৪২ জেলায় ম্যাজেস্ট্রিসি ভবন নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হলেও ভবন হস্তান্তর হয়েছে চার জেলায়, আংশিকভাবে। আট জেলায় ভবন নির্মাণ শেষ, তবে ব্যবহার উপযোগী হয়নি। ২১ জেলায় নির্মাণ কাজ ধীর গতিতে চলছে। নয় জেলায় নির্মাণ শুরুই হয়নি। ২৫ জেলায় সম্প্রসারণ কাজে অগ্রগতি নেই।

নির্মাণ কাজে গতি সঞ্চারে সরকারের ‘দৃশ্যমান পদক্ষেপও নেই’ জানিয়ে বিচারপতি সিনহা বলেন, এ বিষয়ে তিনি নির্দেশনা দিলেও আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি নেই।

বিচারালয়ের বর্তমান সমস‌্যাগুলো তুলে ধরে বাণীতে বলা হয়, জনসংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি আদালত, বিচারক বা কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা। আমতান্ত্রিক জটিলতায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শূন্য পদে নিয়োগও বিলম্বিত হয়। দেশের সব আদালতে কম্পিউটার সরবরাহ বা দ্রুত গতির ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে কাঙ্ক্ষিত সময়ে বিচারপ্রার্থী জনগণকে বিচার দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

নিম্ন আদালতে বিচারকের অনুমোদিত পদসংখ্যা ১৬৫৫টি জানিয়ে সেখানে বলা হয়, এর মধ্যে ৩৮৭টি পদ খালি। অবশিষ্ট ১২৬৮ বিচারক দিয়ে ২৭ লক্ষাধিক বিচারাধীন মামলার নিষ্পত্তি করা অসম্ভব।

এক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির প্রস্তাব হচ্ছে, বর্তমানে শূন্য পদগুলোতে দ্রুত বিচারক নিয়োগ; বিচারক সংখ্যা কমপক্ষে দ্বিগুণ করা।

তা করা গেলে মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তির ব্যবধান অনেকাংশে কমে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধান বিচারপতি।

বাণীতে তিনি তথ‌্য দেন- আমেরিকায় ১০ লাখে ১০৭ জন, কানাডায় ৭৫ জন, ইংল্যান্ডে ৫১ জন, ভারতে ১৮ জন বিচারক রয়েছেন। বাংলাদেশে এই সংখ্যা ১০ জন।

সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নে সুপ্রিম কোর্টের উদ্যোগে ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে জানিয়ে প্রধান বিচারপতি বাণীতে বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোকবল থাকলেও প্রকল্পটির দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি।

এর বাস্তবায়নে প্রধান বিচারপতি সবার সহযোগিতা কামনা করেন।