মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল চালু করলেন প্রধানমন্ত্রী

প্রায় দুই বছর আগে মংলার শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাংকারডুবির পর সুন্দরবন রক্ষায় বহুল আলোচিত মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল পণ্যবাহী নৌ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করেছেন প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Oct 2016, 12:00 PM
Updated : 27 Oct 2016, 12:58 PM

গণভবনে থেকে বৃহস্পতিবার দুপুরে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই চানেল উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সুন্দরবন আমাদের সম্পদ। সুন্দরবন আছে বলেই ঝড় জলোচ্ছ্বাস, অনেক বিপদ-আপদ থেকে বাংলাদেশ রক্ষা পাচ্ছে।”

২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ওই নদীতে ট্যাংকার ডুবলে সুন্দরবনের এ পথ দিয়ে নৌ চলাচল বন্ধের দাবিতে সোচ্চার হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশবাদী সংগঠন। পাশাপাশি বিকল্প নৌপথ হিসেবে মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানল খনন করে তা উন্মুক্ত করার দাবি উঠে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল খনন করে তা উন্মুক্ত করেন। পরবর্তী সময়ে আর কোনো সরকারের আমলে এটা চালু রাখার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।

সেই প্রেক্ষাপট মনে করিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “২১ বছর যারা ক্ষমতায় ছিল, তারা এই মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলটি চালুর রাখার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো বন্দরটাকে প্রায় বন্ধ করে দিচ্ছিল।

“শ্যালা নদী দিয়ে আমাদের জাহাজগুলো চলাচল শুরু করে। এটা সুন্দর বনের জন্য ক্ষতিকর।”

১৯৮০ এর দশকে মংলা-ঘষিয়াখালী সংযুক্ত খালগুলোর মুখ বন্ধ করে চিংড়ি চাষ ও পোল্ডার নির্মাণ করায় চ্যানেলটির ভরাট হতে শুরু করে। ৩০ বছরের মাথায় ২০১০ সালে চ্যানেলটি পুরো শুকিয়ে বন্ধ হয়ে যায়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিক নির্দেশনায় ২০১৪ সালের জুলাই থেকে এই নৌপথটির খনন শুরু হয়। ২০১৫ সালের মে মাস থেকে পরীক্ষামূলভাবে চ্যানেলটি খুলে দেওয়া হয়।

সুন্দরবনের ক্ষতির শঙ্কায় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরোধীতাকারীদের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে আমরা পাওয়ার প্ল্যান্ট করছি। সেটা নিয়ে আমাদের পরিবেশবিদরা কেঁদে মরে।

মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলে ড্রেজিং কার্যক্রম। ফাইল ছবি

“এই যে ঘষিয়াখালী চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়া হল- এর সঙ্গে সংযুক্ত ২৩৪টি খালের মুখ বন্ধ করে চিংড়ি চাষ করা হলো, গাছপালা কেটে চিংড়ির ঘের করা হল; যে জায়গা বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রম সে জায়গাগুলো যে নষ্ট হলো- এসব নিয়ে আমাদের পরিবেশবিদদের কখনো একটু টু শব্দও করতে শুনি নাই। কখনো সুন্দরবন নিয়ে তাদের কোনো দুশ্চিন্তা আমরা দেখি নাই।”

সুন্দরবনের একেবারে ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া শ্যালা নদী রক্ষায় তাদের কোনো উদ্বেগ না থাকলেও বন থেকে ১৪ মাইল দূরের বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করার জন্য তাদের ‘কান্নাকাটিতে’ বিস্ময় প্রকাশ করেন তিনি।

“কিন্তু সুন্দরবনের ভেতরে যে সমস্যা সৃষ্টি করা হয়েছিল- এটা নিয়ে তাদের কোনো কান্নাকাটিও শুনিনি, কোনো আন্দোলনও শুনিনি, কেউ কোনো কথাও বলেনি।”

শ্যালা নদী দিয়ে নৌযান চলাচলের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “শ্যালা নদী ডলফিনের একটা জায়গা। ওখানে ডলফিন আসে। ওই নদীর পানি আমাদের রয়েল বেঙ্গল টাইগার খায়। ওই জায়গাটা বন্যপ্রাণীর একটা অভ্যয়ারণ্য ছিল।”

দুই দফায় জাহাজডুবির পর চলতি বছর মার্চে শেলা নদী দিয়ে সব ধরনের নৌযান চলাচল স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয় নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়।

বৃহস্পতিবার মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল খোলার পাশাপাশি নবনির্মিত ১১টি ড্রেজারেরও উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী।নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় তাদের ১৮টি ড্রেজার ও ১৫টি এক্সাভেটর দিয়ে এই খনন কাজ করে।

মংলা বন্দর সচল রাখার জন্য এই চ্যানেল চালু রাখার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “অল্প সময়ের মধ্যে জাহাজ আসতে পারে। অথচ এটা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।”

৩১ কিলোমিটার মংলা-ঘষিয়াখালী নৌপথের মধ্যে ২৬ কিলোমিটার পথ ১৩ থেকে ১৪ ফুট গভীরতা ও ২০০ থেকে ৩০০ ফুট প্রশস্ত করে খনন করেছে বিআইডব্লিউটিএ।

নৌপথটি চালু হওয়য়ায় ৮১ কিলোমিটার দূরত্ব কমেছে। মংলা-ঘষিয়াখালীর রমজানপুর এলাকায় একটি ‘লুপকাট’ করায় আরও পাঁচ কিলোমিটার দূরত্ব কমেছে।

অভ্যন্তরীণ নৌপথের ৫৩টি রুটে ক্যাপিটাল ড্রেজিং (প্রথমপর্যায় ২৪টি নৌপথ) খনন প্রকল্পের আওতায় ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই নৌপথটি খনন করা হয়েছে।

আমদানি করা মালামাল নৌপথ দিয়ে দেশের উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলে পরিবহনসহ বাংলাদশ-ভারত নৌপ্রটোকল রুটে চলাচলের জন্য মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল ভূমিকা রাখবে।

শেখ হাসিনা বলেন, “পশুর নদীতে প্রচুর পলি পড়ে। আজকে যেখানে সাইলো হলো বা ইপিজেড হলো সেগুলো নদী ড্রেজিং করে ভূমি উত্তোলন করে করা হয়েছে।”

বাংলাদেশের প্রতিটি নদী সচল রাখতে ‘মেইনটেন্যান্স ড্রেজিংয়ের’ ওপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “অনেক সমস্যা.. আমাদের ড্রেজার নাই। কাটলে পরে মাটি রাখার জায়গা নাই। অনেক সমস্যা। তারপরে একরকম জোর করে, সোজাসুজি হুকুম দিয়ে আমরা এই খাল কাটার কাজ শুরু করি।”

নৌ মন্ত্রণালয় অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলের খনন কাজ করেছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২৩৪টি সংযোগ খালে ২ হাজারের বেশি বাঁধ অপসারণ করেছে।

আরো ৮৩টি খাল খনন করার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সেটা করতে হবে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়কে। মন্ত্রী (আনিসুল ইসলাম মাহমুদ) এখানে আছেন। আশা করি, দ্রুত ব্যবস্থা নিবেন।”

প্লাবন ভূমি (টাইডাল বেসিন) করতেও ড্রেজারের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে ড্রেজার তৈরি হচ্ছে। ফলে বাইরে থেকে বেশি কিনতে হবে না। চ্যানেলটা যেন সব সময় উম্মুক্ত থাকে সে জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।”

অনুষ্ঠানে নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান জানান, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সাতটি ড্রেজার সংগ্রহ করেছিলেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে ক্ষমতায় থাকতে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জন্য পাঁচটি ড্রেজার কেনা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জন্য ১৬টি ড্রেজার সংগ্রহ করেছিলেন।

“আমরা ১১৮টি নৌপথ নির্ধারণ করেছি, যা খননে ন্যূনতম দুশো ড্রেজার প্রয়োজন। কিন্তু পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, আমাদের মন্ত্রণালয় ও ব্যক্তি মালিকানায় এখন পর্যন্ত আমাদের একশো ড্রেজার হয়নি।”  

এর আগে প্রধানমন্ত্রী বাগেরহাট জেলার মংলায় নির্মিত ৫০ হাজার মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন কনক্রিট গ্রেইন সাইলোর উদ্বোধন করেন।

মংলা বন্দর থেকে ১৭ কিলোমিটার ভাটিতে ৪২ একর জমির ওপর এই সাইলোতে মোট ৩০টি বিন আছে।

মোট পাঁচশ ৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে চলতি বছরের ২৩ জুন এই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে।

২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী এই প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।