ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, ওই পাঁচজনকে চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে একবার বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল সুদান। কিন্তু কাগজপত্র না থাকায় তাদের ফেরত পাঠানো হয়। সুদানের পুলিশ আবারও তাদের একইভাবে ঢাকায় পাঠিয়েছে। এবারও ঠিক একই কাজ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ।
এদিকে স্বজনরা বুধবার থেকে অপেক্ষা করছেন বিমানবন্দরের বাইরে। কীভাবে এই সঙ্কট থেকে উদ্ধার পাওয়া যাবে, তার পথ খুঁজে পাচ্ছে না নিম্নবিত্তের পরিবারগুলো।
এই পাঁচজন হলেন- রংপুরের মো. ফরিদ মিয়া (২৮), আশিকুর রহমান (২৭), ব্রাক্ষণবাড়িয়ার মো. মাসুদ (৩৫), নওগাঁর মো. সবুজ (৩০) ও ময়মনসিংহের আলমগীর হোসেন (৩০)।
শাহজালালের ইমিগ্রেশন পুলিশের সহকারী কমিশনার আবদুল্লাহ আল মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই যুবকদের কাছে বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য পাসপোর্ট বা আউটপাস কোনোটাই নাই। তারা বাংলাদেশি কিনা- সেটি নিশ্চিত নই। তাদের কাছে আরবি ভাষায় লেখা সুদান পুলিশের একটি করে কাগজ আছে। সেখানে তাদের বাংলাদেশি বলা হচ্ছে।”
এই ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের কোনো নাগরিকের পরিচয় শনাক্ত করবে বাংলাদেশের দূতাবাস। সুদান পুলিশ সেটা করতে পারে না।
“আগেও তারা একইভাবে এদের ঢাকায় পাঠিয়েছিল। তখনও তাদের সুদানে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। এখন দেশের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে আবারও তাদের সুদানে পাঠানো হবে।”
আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, সুদানে বাংলাদেশের দূতাবাস না থাকায় পাশের দেশ মিশরে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে ওই পাঁচজনের পরিচয় নিশ্চিত করতে হবে। তারা বাংলাদেশি হয়ে থাকলে আউট পাস নিয়ে দেশে ফিরে আসতে পারবেন।
বিমানবন্দরের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “সবাই জানে ওই ছেলেরা বাংলাদেশি। তাদের পরিবারও বিমানবন্দরে সন্তানদের নিতে এসেছে। তাদের কাছে ওদের বুঝিয়ে দিলে দরিদ্র পরিবারের ওই ছেলেগুলোকে আবার সুদানে গিয়ে সেখানকার পুলিশের হেফাজতে থাকতে হয় না।”
বিমানবন্দরের বাইরে যে পরিবারগুলো অপেক্ষায় রয়েছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে কি না জানতেই চাইলে সহকারী কমিশনার আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘নিয়মের বাইরে’ কিছু করার সুযোগ তাদের নেই।
‘পরিচয় নিশ্চিতে পুলিশে দেওয়া হোক’
বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষায় থাকা মো. আনোয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২০০৯ সালে দালালের মাধ্যমে শ্রমিক হিসেবে সুদানে যান তার ছেলে সবুজ মিয়া। কয়েক মাস দেশে টাকাও পাঠিয়েছিলেন। তবে ধীরে ধীরে টাকার পরিমাণ কমে আসতে থাকে; এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়।
সেখানে চাকরি বদলে আরও কিছুদিন কাজ করেন সবুজ। পরে পাসপোর্ট ও দরকারি কাগজপত্র আটকে রেখে নামমাত্র অর্থে তাকে কাজ করতে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ করেন তার বাবা।
সবুজ এক পর্যায়ে দেশে ফোন করে জানান, তার পক্ষে আর সুদানে থাকা সম্ভব না। এদিকে মালিকও পাসপোর্ট আটকে রেখেছে। দেশে ফেরার আশায় সেখানে বাংলাদেশি এক দালাল ধরেন সবুজ। সেই দালালকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে ছেলেকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করার কথা জানান আনোয়ার।
তিনি জানান, সেই চেষ্টার পর গত ১৬ অক্টোবর সবুজসহ একই পরিস্থিতির শিকার পাঁচ বাংলাদেশি ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছায়। কিন্তু বাংলাদেশে প্রবেশের বৈধ কাগজপত্র সঙ্গে না থাকায় ইমিগ্রেশন বিভাগ তাদের সুদানে ফেরত পাঠায়।
“সেখানে কয়েক দিন থাকার পর সুদানে এক বাংলাদেশি দালালের মাধ্যমে আবার কাগজপত্র তৈরি করে সৌদি এয়ারলায়েন্সে বুধবার দেশে নামে ওরা। কিন্তু এবারও ইমিগ্রেশন থেকে বের হতে দিচ্ছে না।”
আনোয়ারের দাবি, তার ছেলেকে সুদানে না পাঠিয়ে দেশে পুলিশের হেফাজতে দেওয়া হোক। সবুজ বাংলাদেশি কি না- সেটা পুলিশ তদন্ত করে দেখে সিদ্ধান্ত দিক।
রংপুরের আজিজুল ইসলাম জানান, তার ছোট ভাই আশিকুর রহমানকে বাড়ি নিয়ে যেতে বুধবার থেকে তিনি বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু ইমিগ্রেশন পুলিশ বলছে, আশিক বাংলাদেশে ঢুকতে পারবে না।
“ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে থেকেই আশিক ফোন করে দেশে ফেরার খবর আমাদের জানিয়েছে। কাগজপত্রে সমস্যা থাকলে ও সুদান থেকে এল কীভাবে,” প্রশ্ন করেন আজিজ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আবদুল মালেক জানান, তাদের বাড়ি কসবা উপজেলার রঘুনাথপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে। ইমিগ্রেশনে আটকা পড়া মো. মাসুদ তার ভাগ্নে।
“মাসুদরা আট ভাই-বোন। দুই বছর আগে শ্রমিক হিসেবে ও সুদানে যায়। পরে মালিক পাসপোর্ট রেখে দেয়, প্রায় বিনা পয়সায় কাজ করতে বাধ্য করে।”
রঘুনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য মো. ফরিদও বিমানবন্দরে এসেছেন মালেকের সঙ্গে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “মাসুদকে ছাড়িয়ে নিতে আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করছি। বিদেশে ওর পাসপোর্ট রেখে দিয়ে যেটা করছে, সেটাও তো অন্যায়। তাদের বিচার কে করবে?”
রংপুরের শামসুল হুদা জানান, জমি বিক্রি করে ছেলে ফরিদ মিয়াকে তিনি বিদেশে পাঠিয়েছিলেন ‘সুন্দর জীবন’ পাওয়া আশায়। ফরিদ এখন সেখানে থাকতে চান না, আবার দেশেও ঢুকতে পারছেন না।
“আমরা দরিদ্র মানুষ। ছেলে আবারও যদি বিদেশি পুলিশের হাতে আটকা পড়ে, ছাড়ায়ে আনার টাকা আমার নাই।”
‘বাংলাদেশি নাগরিক’ হয়েও, শনাক্ত করার জন্য বাবা নিজে উপস্থিত থাকার পরও ছেলেকে কেন দেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না, সেই প্রশ্নের উত্তর জানতে চান শামসুল হুদা।