শুক্রবার প্রেসিডেন্ট শি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকের পর স্বাক্ষরিত চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকগুলোর মধ্যে চীনের এই উদ্যোগ নিয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার কথা বলা হয়েছে ওই বৈঠকের পর আসা যুক্ত বিবৃতিতে।
চীন-বাংলাদেশের ‘সর্বাত্মক অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা’র সম্পর্ককে ‘কৌশলগত অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতার’ জায়গায় নিয়ে যেতেও সম্মত হয়েছেন তারা। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সহযোগিতার মতৈক্য হয়েছে।
২০১৩ সালে চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড উদ্যোগ তুলে ধরেন প্রেসিডেন্ট শি। এরপর থেকে এই উদ্যোগকে ঘিরেই চলছে দেশটির অর্থনৈতিক কূটনীতি।
এই উদ্যোগ শুরুর পর থেকে বিদেশে অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে চীন।
সিল্ক রোড ইকোনোমিক বেল্ট এবং একুশ শতকের মেরিটাইম সিল্ক রোডকে সংযুক্ত করে নেওয়া এই উদ্যোগের আওতায় এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার দেশগুলোকে একটি বাণিজ্য ও অবকাঠামো নেটওয়ার্কে সম্পৃক্ত করতে চাইছে চীন, যার মধ্য দিয়ে কার্যত প্রাচীন সিল্ক রোড রুটকে পুনরায় ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশা।
এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ তৈরিতে বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার বা বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোর নিয়েও কাজ করছে বেইজিং।
এই উদ্যোগের পাশাপাশি শিল্পায়নের সক্ষমতা বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, বিনিয়োগ, সমুদ্র খাত সহযোগিতা (মেরিটাইম কোঅপারেশন), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা এবং সংস্কৃতি ও দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি নিয়ে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে।
চীন-বাংলাদেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা নিয়ে মতৈক্য হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ে সফর বিনিময়ের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ, সরঞ্জাম, প্রযুক্তি এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন নিয়ে সহযোগিতা বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে।
“সন্ত্রাস দমন নিয়ে সংলাপ অনুষ্ঠানের সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখতে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছে,” বলা হয়েছে যুক্ত বিবৃতিতে।
দুই দেশের জনগণের কল্যাণে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে একসঙ্গে কাজ করতে রাজি হয়েছে চীন ও বাংলাদেশ। এই অঞ্চলের উন্নয়ন ত্বরাণ্বিত করতেও কাজ করবে দুই দেশ।
“অভিন্ন আকাঙ্ক্ষা এবং দুই দেশের মধ্যকার সহযোগিতার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ওপর ভিত্তি করে উভয় পক্ষ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে কৌশলগত অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতায় উন্নীতে সম্মত হয়েছে,” বলা হয়েছে দুই নেতার যুক্ত বিবৃতিতে।
এক চীন নীতি এবং দেশটির মৌলিক জাতীয় স্বার্থ, এর সার্বভৌমত্ব ও ভৌগলিক অখণ্ডতা রক্ষায় চীনের পদক্ষেপের প্রতি ঢাকার সমর্থনের প্রশংসা করেছে বেইজিং।
‘স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রাখা এবং জাতীয় স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন প্রচেষ্টায়’ সমর্থন দেওয়ার জন্য চীনকে ধন্যবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ।
দুইপক্ষই উচ্চ পর্যায়ে মত বিনিময় বাড়ানো এবং বহুপক্ষীয় ফোরামের সাইডলাইনে দুই দেশের নেতাদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার বিষয়ে একমত হয়েছে।
এছাড়া ১৩২০ মেগাওয়াটের পায়রা তাপভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে একাধিক লেনের টানেল নির্মাণ, দাসেরকান্দি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, ছয়টি নৌযান কেনা, পদ্মা সেতু এবং চার স্তরের জাতীয় ডেটা সেন্টার স্থাপনের মতো বেশ কিছু প্রকল্পে অগ্রগতি হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেন তারা।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সমতা ও উভয় পক্ষের স্বার্থরক্ষার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ, আইসিটি, নদী ব্যবস্থাপনা এবং অবকাঠামোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের ২২টি প্রকল্পে সহযোগিতার প্রস্তাবের বিষয়ে বিবেচনা ও চীনা উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে রাজি হয়েছে চীন।
উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহযোগিতা বাড়াতে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি হওয়ায় দুইপক্ষই সন্তোষ প্রকাশ করেছে।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ ও এর উন্নয়নে একযোগে কাজ করতেও সম্মত হয়েছে দুই পক্ষ। ড্রেজিং ও ভূমি পুনরুদ্ধারসহ নদী ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সহযোগিতা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়েও একমত হন তারা।
এছাড়া চীন-বাংলাদেশ মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু করবে উভয়পক্ষ।
চীনা উদ্যোক্তারা যাতে বাংলাদেশে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে ঢাকা।
সমুদ্র সম্পর্কিত বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার ব্যাপক ক্ষেত্র রয়েছে বলে দুই পক্ষই মনে করে; এ লক্ষ্যে সমুদ্র সম্পর্কিত বিষয়ে সহযোগিতার কৌশল নির্ধারণে সংলাপের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে দুই দেশ।
জনপ্রশাসন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, কৃষি, স্বাস্থ্য সেবা এবং শিল্পকলার বিভিন্ন বিষয়সহ নানা ক্ষেত্রের বাংলাদেশি পেশাজীবীদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া এবং পেশাজীবীরা যাতে বাংলাদেশেও এ ধরনের প্রশিক্ষণ নিতে পারেন সে বিষয়ে সহযোগিতা করতে রাজি হয়েছে চীন।
বাংলাদেশের জন্য চীনা ভাষী ৫০০ শিক্ষককে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ১০০ বাংলাদেশি সংস্কৃতি কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেবে বেইজিং। এছাড়া ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৬০০ বাংলাদেশি ছাত্রকে তাদের দেশ সফরের আমন্ত্রণ জানাবে।
২০১৭ সালকে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ‘বন্ধুত্ব ও আদান-প্রদানের’ বছর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।