সৈয়দ হককে ‘আপন’ ভাবুন: অনুরোধ স্ত্রীর

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হককে ‘আপন মানুষ’ মনে করে তাকে মূল্যায়নের অনুরোধ জানিয়েছেন তার স্ত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হক।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Oct 2016, 05:50 PM
Updated : 1 Oct 2016, 06:04 PM

শনিবার রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে সদ্যপ্রয়াত লেখকের স্মরণসভায় লেখকপত্নী বলেন, “জীবদ্দশায় তিনি অনেক গালি শুনেছেন। বিভিন্ন মিডিয়াতে তাকে নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে, হাসি-ঠাট্টা হয়েছে। এমনকি মৃত্যুর পরেও হয়েছে।

“এসব ভুলে গিয়ে তাকে নিজের খুব আপন একজন মানুষ ভাবুন।”

সৈয়দ হকের মৃত্যুর পর নির্বাসিত লেখক তসলিমা নাসরিন এক ফেইসবুক স্ট্যাটাসে তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘ক’ এর ইস্যুটিকে  সামনে আনেন। ২০০৩ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থে তসলিমা তার ব্যক্তিগত জীবনের নানা দিক নিয়ে খোলামেলা আলোচনায় সৈয়দ শামসুল হককে জড়ালে তার বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকার মানহানির মামলা হয়। সুরাহা না হওয়া সেই মামলার পাওয়ার অব এটর্নি, মামলার অগ্রগতি নিয়ে তসলিমা তার ফেইসবুক স্ট্যাটাসে জানতে চান।

পাঠকমহলের কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনায় মেতে ওঠেন।

স্মরণসভায় এই সমালোচকদের উদ্দেশ্যে আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, “সৈয়দ হককে আমি ঠিকমতো সঙ্গ দিতে পারিনি। নিজের কাজে এতই ব্যস্ত ছিলাম যে, আমার মধ্যে ক্ষোভ ও রাগের সঞ্চার হচ্ছে। আমাদের কাছের মানুষটি কত দূরে ছিলেন। সৃজনশীলতার ভেতরে নিজেকে তিনি এত বেশি ব্যস্ত রাখতেন…।

“সত্যিকার অর্থে আমার মধ্যে খুব বেশি অপরাধ বোধ কাজ করছে, তাকে কেন আমি আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করলাম না। মানুষটিকে আমি চোখে দেখলাম না। এই শোক সারা জীবন আমি ভেতরে বয়ে বেড়াব।”

জীবনসঙ্গীকে ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’ মানুষ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “লেখক, নাট্যকার, কবি, প্রাবন্ধিক হিসেবে তার নানা মূল্যায়ন রয়েছে। শেষ যাত্রায় পাঠক ও ভক্তদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন, আমাদের পরিবার তথা গোটা বংশের চোখ সেদিন আরও বেশি অশ্রুসজল হয়েছে।”

শোক সভায় এসে সৈয়দ হকের ছেলে দ্বিতীয় সৈয়দ হক বলেন, “বাবার কাছে দুটি অতি প্রিয় ও প্রাসঙ্গিক ছিল সংস্কৃতি ও নাগরিক। বাবা নিজেকে সব সময় এক বিশ্ব নাগরিক ভাবতেন। সাধারণ মানুষ যে তার কী প্রিয় ছিল! পুরো বাংলাদেশই যে তার হাতের মুঠোয় ছিল।”

মৃত্যুশয্যায় ‘স্পেশাল অর্ডার’ দিয়ে ছেলের জন্য লাল-কালো-সাদা পাঞ্জাবি তৈরি করিয়েছেন সৈয়দ হক। বাবার দেওয়া সেই সাদা পাঞ্জাবিটি তিনি পরেছিলেন তার অন্তিম যাত্রায়, কালোটি পরে এসেছিলেন শোকসভায়।

“আজকের শোকসভাকে কেউ হয়তো শোকসভা বলবেন না। কিন্তু আমি তো আর বাবার হাতের ছোঁয়া পাব না, তার মুখের হাসি দেখতে পাব না, এমনকি তার তিরস্কারও আর শুনতে পাব না...আমার এই শোক তো কোনোদিনও যাবে না,” বলেন দ্বিতীয় সৈয়দ হক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, “সৈয়দ শামসুল হকের মৃত্যু অকাল মৃত্যু বলেই মনে হয়। তিনি ছিলেন জাতির পথপ্রদর্শক। তার প্রয়োজনীয়তা কখনও ফুরিয়ে যাবে না।

“তার লেখা পাঠ এবং পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে তার সেতুবন্ধন রচনাতেই তার অসাধারণ অবদানকে স্মরণ করতে পারি আমরা, সেটি হবে আমাদের কাজ।”

সৈয়দ হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘গেরিলা’ নানা শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে।

চলচ্চিত্রটির পরিচালক নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন,  “দেশে যখন জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত রাষ্ট্র যখন নানা চ্যালেঞ্জের মুখে উপনীত হয়েছে, তখনই ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় তিনি জাতির শৌ‌র্য-বীর্যের ইতিহাস তুলে ধরেছেন।

“সৈয়দ হোক শোকে নয়, তিনি তার লেখনীতে বাঙালি পাঠকের মনে উদযাপিত হবেন অনাদিকাল।”

‘গেরিলা’ চলচ্চিত্রের অন্যতম অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান বলেন, “দীর্ঘদিন তার সঙ্গে আড্ডা দিয়েছি। তিনি চিরঞ্জীব ব্যক্তিত্ব। আমাদের অস্তিত্বে মিশে রয়েছেন।”

বহুমাত্রিক লেখক সৈয়দ শামসুল হক কালের ধারাকে ‘অতিক্রম’ করে ‘এক প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে মন্তব্য করেন সাংবাদিক আবেদ খান।

“বাংলাদেশ, বাঙালি জাতির ইতিহাস, তার উৎসকে সমকালীন সাহিত্যে তুলে এনেছেন। মানুষের চিন্তার জগতকে প্রসারিত করে এমন স্থানে পৌঁছে গেছেন যাকে প্রতিনিয়ত স্মরণ করতে হবে।তিনি প্রয়াত হননি, জীবনের অন্য একটি পর্যায়ে গিয়ে তিনি নিজেকে অন্য একটি দিগন্তে উন্মোচিত করেছেন।”

কবি মুহম্মদ নুরুল হুদার কাছে সৈয়দ হক ‘চিরজীবিত’।

তিনি বলেন, “গত পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে তার চেয়ে সৃষ্টিশীল কোনো মানুষ দেখিনি। পরিপূর্ণ মানুষ ছিলেন, সৃষ্টিশীল ছিলেন, নান্দনিকতার পক্ষে ছিলেন। এমন মানুষকে বারবার চাই। তার মঙ্গল চেতনা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারলে সঠিক শ্রদ্ধা জানানো হবে।”

মৃত্যুশয্যায় শুয়ে সৈয়দ শামসুল হক শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’ নাটকের অনুবাদ করেছেন। ওই অনুবাদ অবলম্বনে মঞ্চ নাটক নির্দেশনার ইচ্ছা প্রকাশ করেন নাট্যব্যক্তিত্ব আতাউর রহমান।

ভাষা আন্দোলনের পরে বাংলা সাহিত্যে কবিতা আন্দোলনের ‘অগ্রজ সেনা’ সৈয়দ হকের নানা অবদানের কথা তুলে ধরেন নাট্যজন মামুনুর রশীদ। নানা সাংস্কৃতিক আন্দোলন, মঞ্চনাটকে তার নানা অবদানের কথাও শ্রদ্ধাচিত্তে স্মরণ করেন বাংলা মঞ্চনাটকের অন্যতম এই পুরোধা।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, “সৈয়দ শামসুল হক সাংস্কৃতিক কর্মীদের আত্মার আত্মীয় ছিলেন। তিনি আমাদের নিরন্তর প্রেরণার উৎস ছিলেন, সব সময় তাই থাকবেন।”

সৈয়দ হককে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল হাসান খান, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি মুহাম্মদ শফিকুর রহমান, নাট্যজন ম. হামিদ, চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম, পথনাটক পরিষদের সভাপতি মান্নান হীরা, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান কবি মোহাম্মদ সাদিক।

আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আহকামউল্লাহ সৈয়দ হকের ‘আমার পরিচয়’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন। ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় পাঠ করেন ‘নুরলদীনের সারাজীবন’ নাটকের অংশবিশেষ। মামুন জাহিদ খান ‘অনেক সাধের ময়না আমার’ সৈয়দ শামসুল হকের লেখা এ গানটি গেয়ে শোনান, ফকির আলমগীর ও তার দল ঋষিজের শিল্পীরা সৈয়দ হকের লেখা ‘ভয় নেই কোন ভয়, জয় সাম্যের জয়’ গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন।

সৈয়দ হক স্মরণে স্বরচিত কবিতা ‘তোমার প্রেমের আলো’ পাঠ করেন জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি কবি মুহাম্মদ সামাদ। ‘আমাকে আপনারা ক্ষমা করবেন’ শীর্ষক সৈয়দ হককে উৎসর্গীকৃত স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তারিক সুজাত।