রামপাল: ইউনেস্কোর ‘৩৬ তথ্যে ভুল’ পেয়েছে বিদ‌্যুৎ কোম্পানি

রামপাল বিদ‌্যুৎ কেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের সম্ভাব‌্য ক্ষতির আশঙ্কা করে উদ্বেগ জানিয়ে যে চিঠি ইউনেস্কো পাঠিয়েছে, তাতে ৩৬টি ভুল পাওয়ার দাবি করেছে এই বিদ‌্যুৎ কেন্দ্রের কোম্পানি।

নিজস্ব প্রতিবেদকখুলনা প্রতিনিধি ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Sept 2016, 03:34 PM
Updated : 27 Sept 2016, 03:43 PM

মঙ্গলবার খুলনা প্রেস ক্লাবে এক মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক উজ্জ্বল ভট্টাচার্য জাতিসংঘ সংস্থার প্রতিবেদন নিয়ে এই দাবি করেন।

এদিকে এই তাপবিদ‌্যুৎ কেন্দ্রবিরোধী তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি একই দিন এক বিবৃতিতে ইউনেস্কোর উদ্বেগ বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে এই পদক্ষেপ থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছে।

সুন্দরবনের কাছে বাগেরহাটের রামপালে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ‌্যোগে কয়লাভিত্তিক ‘মৈত্রী সুপার পাওয়ার থারমাল’ বিদ‌্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে।

ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ‌্য সুন্দরবন এই বিদ‌্যুৎ কেন্দ্রের বায়ু, শব্দ ও পানি দূষণের কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দাবি করে এর বিরোধিতা করে আসছে পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন।

বিরোধিতার মধ‌্যেই এই বিদ‌্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাওয়া সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পরিবেশগত ক্ষতির মাত্রা ন‌্যূনতম রেখেই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

এর মধ্যেই ইউনেস্কো সুন্দরবনের উপর এই বিদ‌্যুৎ কেন্দ্রের নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা তুলে ধরে সরকারকে একটি প্রতিবেদন পাঠায়। 

জাতিসংঘ সংস্থার উদ্বেগের বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর আগামী সপ্তাহে জবাব দেবে বলে বিদ‌্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছিলেন। এর আগেই প্রতিক্রিয়া নিয়ে হাজির হল প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কোম্পানি।

কোম্পানির ব‌্যবস্থাপনা পরিচালক উজ্জ্বল বলেন, “ইউনেস্কোর পাঠানো ১০ পাতার ওই রিপোর্ট ৩৬টি তথ্যগত ভুল রয়েছে।”

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, “ইউনেস্কো বা বিশ্ব ব্যাংক যা বলবে তা সব সময় ভালো কিছু হবে এমন নয়। যারা উন্নত, তারা সব সময়ই অনুন্নত দেশকে দমিয়ে রাখতে চায়। এ কারণে অনুন্নত দেশের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজকে তারা বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করে।”

বিদ‌্যুৎ কেন্দ্রের নকশা

বিদ‌্যুৎ কেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না দাবি করে তিনি বলেন, পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার বিষয়টি মাথায় রেখেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে।

কলকাতায় চারটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকার তথ‌্য তুলে ধরে ভারতের সঙ্গে যৌথ এই কোম্পানির এমডি বলেন, সেগুলোর কারণে কোনো ক্ষতি হচ্ছে না।

সভায় জানানো হয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায় ৯৩ শতাংশ, অন‌্যদিকে বাংলাদেশে এ ধরনের প্রকল্প দুই শতাংশেরও কম।

প্রকল্পের অবস্থান নিয়ে বলা হয়, সুন্দরবনের প্রান্তসীমা থেকে বিদ‌্যুৎ কেন্দ্রের দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার এবং সংরক্ষিত বন থেকে ৬৫ কিলোমিটার। প্রকল্পে ব্যবহৃত চিমনির উচ্চতা হবে প্রায় ৯০০ ফুট। পাশাপাশি এই প্রকল্পে ব্যবহার করা হচ্ছে আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি। ফলে বনের ক্ষতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।

সভায় খুলনার জেলা প্রশাসক নাজমুল আহসান বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে। ফলে ওই এলাকায় মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

‘না বুঝেই আন্দোলন’

যারা রামপাল বিদ‌্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে আন্দোলন করছেন, তারা না বুঝেই বিরোধিতা করছেন বলে দাবি করেন এই প্রকল্পের পরামর্শক প্রকৌশলী খন্দকার আজিজুর রহমান।

মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, “পরিবেশবাদীরা অনেক কিছু না জেনেই আন্দোলন করে যাচ্ছে।”

রাজপথে আন্দোলন

তেল-গ‌্যাস রক্ষা কমিটির সদস‌্য সচিব অর্থনীতির অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের সমালোচনা করে প্রকৌশলী আজিজ বলেন, “তিনি পরিবেশের কী বোঝেন?

“পৃথিবীর অনেক দেশেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। এটা পরীক্ষিত, এতে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয় না।”

আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনা করতে চাইলেও সাড়া পাচ্ছেন না বলেও দাবি করেন এই প্রকৌশলী।

“সুন্দরবনের ক্ষতির ব্যাপারটি দেখার জন্য তাদের আসতে একাধিকবার আমন্ত্রণ জানানো হলেও তারা ভয়ে আসছেন না।”

‘ইউনেস্কোকে আমলে নিন’

ইউনেস্কোর প্রতিবেদনের সঙ্গে একমত হতে সরকারকে আহ্বান জানিয়ে তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির বিবৃতিতে বলা হয়, “ইউনেস্কো টিম বাংলাদেশে এসে সুন্দরবন এলাকা পরিদর্শন করে বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষন করে সরকারকে প্রদত্ত রিপোর্টে দেখিয়েছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবন কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ সুন্দরবনের জন্য হুমকিস্বরূপ সব বানিজ্যিক তৎপরতা বন্ধ করতে বলেছেন।

“কোম্পানি, ভূমিগ্রাসী ও বনগ্রাসী গোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত না হয়ে নির্মোহ বিচার-বিশ্লেষণ করলে সরকারও যে একই সিদ্ধান্তে আসবে, সেটা আমরা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি।”

এই উদ্বেগ আমলে নেওয়া না হলে সুন্দরবন ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’র তালিকা থেকে বাদ পড়ে যাবে বলে শঙ্কার কথাও সরকারকে জানানো হয়।