শেষঘুমে কবি শহীদ কাদরী

‘প্রিয়তমা’ দেশের মাটিতে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন কবি শহীদ কাদরী।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 August 2016, 12:17 PM
Updated : 31 August 2016, 12:33 PM

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভক্ত, পাঠক, সাংস্কৃতিক কর্মী, সর্বস্তরের মানুষের ভালবাসা আর অভিবাদনে শেষবার সিক্ত হওয়ার পর মিরপুর বুদ্ধিজীবী গোরস্তানে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।

সম্মিলিত সাংস্কৃকি জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন, বুধবার বেলা ৩টায় কবির দাফন সম্পন্ন হয়েছে।

গত রোববার নিউ ইয়র্কের একটি হাসপাতালে মারা যান ৭৪ বছর বয়সী শহীদ কাদরী, যার কবিতায় আধুনিক বাঙালির মনন ও জীবনবোধের উন্মোচন ঘটেছে বিষাদ ও বিচ্ছিন্নতার বিমূর্ত রূপ নিয়ে।

রাষ্ট্রীয় ব্যাবস্থাপনায় বুধবার সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে এমিরেটস এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে কবির মরদেহ ঢাকা পৌঁছায়। এরপর বারিধারায় বড় ভাইয়ের বাসা ঘুরে বেলা সোয়া ১১টায় কফিন পৌঁছায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে শুরু হয় সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে শহীদ কাদরীর যন্ত্রণা উচ্চারিত হয়েছিল ‘হন্তারকদের প্রতি’ কবিতায়। তিনি লিখেছিলেন- ‘এর চেয়ে ভয়াবহ কোনো কথা আমি আর শুনবো না কোনোদিন’।

শহীদ মিনারে তার কফিনে প্রথম শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করা হয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মিয়া মো. জয়নুল আবেদিন ও বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল।

এরপর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে অতিরিক্ত সচিব মনজুরুর রহমান এবং আওয়ামীলীগের পক্ষে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফুল দেন কবির শবাধারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব এফিয়া প্যাসিফিক, সিপিবি, জাসদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, বাংলা একাডেমি, গণসংহতি আন্দোলন, শিল্পকলা একাডেমি, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব, ছায়ানট, ঢাকা থিয়েটার, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার, খেলাঘর, জাতীয় কবিতা পরিষদ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয় কবির প্রতি।

এছাড়া ব‌্যক্তি পর্যায়ে কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানান রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, মফিদুল হক, আখতার হুসেন, মুনতাসীর মামুন, আবুল হাসনাত, ইমদাদুল হক মিলন, হারুন হাবীব, আবুল বারক আলভী, শামসুজ্জামান খান, অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, অধ্যাপক আহমেদুল কবির, দিলারা হাফিজ, কবি মুহাম্মাদ নুরুল হুদা, মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, মনজুরুল আহসান বুলবুল, ভাস্বর বন্দোপাধ্যায়, কবি নাসির আহমেদ, ম হামিদসহ অনেকে।

শ্রদ্ধা নিবেদনের শেষে কবির মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে। জোহরের নামাজের পর সেখানে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

প্রায় চার দশক আগে প্রবাসে স্বেচ্ছা নির্বাসন নেওয়া কবি শহীদ কাদরীর জন্ম ১৯৪২ সালের ১৪ অগাস্ট কলকাতায়।

সাতচল্লিশে দেশভাগের পর বাংলাদেশে আসে কবির পরিবার। ১৯৭৮ সালের পর থেকেই বাংলাদেশের বাইরে তিনি। জার্মানি, ইংল্যান্ড হয়ে ১৯৮৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হন।

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন শহীদ কাদরী। জীবনের শেষ পাঁচ বছর ধরে হুইল চেয়ারে ছিল তার চলাফেরা।

পঞ্চাশোত্তর বাংলা কবিতায় আধুনিক মনন ও জীবনবোধ সৃষ্টিতে যে কজন কবি উল্লেখযোগ্য তাদের মধ্যে অন্যতম শহীদ কাদরী।

‘উত্তরাধিকার’, ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’, ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’ ও আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’ এই চারটি কাব্যগ্রন্থ দিয়েই বাংলার জনপ্রিয় কবিদের একজন শহীদ কাদরী।

আধুনিক নাগরিক জীবনের সুখ-দুঃখ, প্রেম, স্বদেশচেতনার পাশাপাশি বিশ্ব নাগরিক বোধের সম্মিলন ঘটেছে তার কবিতায়। ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি ও ২০১১ সালে একুশে পদক দেওয়া হয় তাকে।

আজন্ম নাগরিক কাদরী তার জীবনবোধে তিরিশ উত্তর আধুনিকতাকে সঞ্চারিত করে বাংলা কবিতাকে দিয়েছেন নতুন স্পন্দন। নগর জীবনের নৈকট্য ও দূরত্বকে ভাষা, ভঙ্গি ও বক্তব্যে করে গেছে ঋগ্ধ।

বার বার আবাস বদলের জীবনে শহীদ কাদরীর কাছে স্বদেশ ছিল প্রিয়তমা, কবিতায় যাকে তিনি ‘অভিবাদন’ জানিয়ে গেছেন। লিখে গেছেন-

“ভয় নেই

আমি এমন ব্যবস্থা করবো যাতে সেনাবাহিনী

গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে

মার্চপাস্ট করে চলে যাবে

এবং স্যালুট করবে

কেবল তোমাকে প্রিয়তমা।”