‘কবিতায় মৃত্যুকে জয় করেছেন শহীদ কাদরী’

শেষ ‘অভিবাদনে’ এসে প্রয়াত কবি শহীদ কাদরীর কবিতার গুণগত মান ও স্বদেশ চিন্তার বিষয়টি বড় করে প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজন, কবি ও শুভানুধ্যায়ীরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 August 2016, 10:41 AM
Updated : 31 August 2016, 04:50 PM

বুধবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকা কবির কফিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে জড়ো হন তারা, ফুলে ফুলে ঢেকে দেন শবাধার।

শ্রদ্ধা জানাতে এসে লেখক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, “আমাদের সাহিত্যের আলোগুলো দিনে দিনে নিভে যাচ্ছে। অনেক কবি-সাহিত্যিক তাদের লেখনি দিয়ে মৃত্যুকে জয় করেন, শহীদ কাদরীর তার কবিতা দিয়ে মৃত্যুকে জয় করেছেন।”

“সবমিলিয়ে ১২৬টি কবিতা লিখলেও প্রত্যেকটি বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে।”

আড্ডাবাজ ও আমুদে মানুষ শহীদ কাদরী সৃষ্টিশীল আড্ডার বোধ থেকে ‘কুড়িয়ে’ কবিতা রচনা করেছেন বলে মূল্যায়ন কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদার।

তিনি বলেন, “ঢাকা শহরে এমন জায়গা কম আছে যেখানে তিনি আড্ডা দেননি। এ আড্ডা কবিতার আড্ডা, সৃষ্টিশীলতার আড্ডা। সে আড্ডায় দেশ বিদেশের কবিতার প্রবণতা নিয়ে কথা বলতেন। সেই আড্ডা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে যা লিখতেন সেটা ছিল তার স্বনির্বাচিত, সম্পাদিত কবিতা।”

বাংলাদেশের মানুষের ব্যক্তিস্বত্ত্বা ও জাতিস্বত্ত্বার কথা তার কবিতায় উচ্চকিত হয়েছিল মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কবিতার মধ্য দিয়েই তিনি বেঁচে থাকবেন দীর্ঘ সময়।”

১৯৭৮ সালে জার্মানিতে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যান কবি শহীদ কাদরী। অজানা এক অভিমানে কবি আর ফেরেননি দেশে। তার শেষ ইচ্ছায় এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত তহবিলের অর্থে তার মরদেহ এসেছে প্রিয় স্বদেশে।

শহীদ কাদরীর এ ‘দেশে ফেরাকে’ তাই ‘রাজসিক প্রত্যাবর্তন’ হিসেবে দেখেন প্রাবন্ধিক-গবেষক মফিদুল হক।

কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের এ ট্রাস্টি বলেন, “তিনি খুব বেশি লেখেননি। যা লিখেছেন ভাস্করের মতো খোদাই করে লিখেছেন। কবিতায় তিনি যে জীবন দর্শন তুলে এনেছেন সেখানে বারবার বাঙালি পাঠককে ফিরে আসতে হবে।

“ষাটের দশকে যা লিখেছেন বর্তমান সময়েও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তিনি কালজয়ী হয়ে উঠেছেন প্রকাশভঙ্গীতে, ভাষা ব্যবহারে, জীবন দর্শনে।

নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, তিনি বাংলাদেশের অমর কবিদের কাতারে স্থান পাবেন। এতো কম কবিতা লিখে এতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠা বিরল ঘটনা। তার কবিতা এখনো আধুনিক এবং নান্দনিক।

আরেক নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, “ষাটের দশকে তিনি যে কবিতা লিখেছেন, তা এখনও প্রাসঙ্গিক। সবগুলো কবিতায় তার তারুণ্যের ছাপ ও আধুনিকতা বিদ্যমান।

“তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা…প্রিয়তমা

ভয় নেই এমন দিন এনে দেব

দেখ সেনাবাহিনীর বন্দুক নয়, শুধু গোলাপের তোড়া হাতে

কুচকাওয়াজ করবে তোমার সামনে,

শুধু তোমাকেই তোমাকেই স্যালুট করবে তারা দিনরাত।”

শহীদ কাদরীর লেখা পঙক্তিগুলো স্মরণ করে মামুনুর রশিদ বলেন, “পুরো পৃথিবী যখন যুদ্ধ বিধ্বস্ত তখন তিনি চিন্তা করছেন, বুলেট-গ্রেনেডের বদলে সৈন্যরা তার প্রেমিকার জন্য ফুল হাতে এগিয়ে আসছে, কী অসাধারণ!”

স্বামীর বিয়োগে নিজের ‘প্রিয় মানুষটিকে’ হারিয়েছেন বলে জানান শোকাতুর স্ত্রী নীরা কাদরী।

তিনি বলেন, “শহীদ কাদরী কেবল আমার স্বামী ছিলেন না, ছিলেন আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। তার মুখের কথাও ছিল কবিতার মতো।

“কবিতা দিয়েই শহীদ কাদরীর সঙ্গে আমার পরিচয়। তার একটা অভিমান ছিল, তিনি ভাবতেন, ‘দেশ আমাকে ভুলে গেছে’। তিনি বলতেন, ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মধ্যে কোনো সম্মান নেই।”

স্বামীর প্রচারবিমুখতার কথা উল্লেখ করে নীরা কাদরী বলেন, “উনি বলতেন, পাঁচজন মানুষও যদি আমার কবিতা পড়ে মনে রাখে এতটুকু আমার জন্য যথেষ্ট।”

শহীদ কাদরীকে বাংলা সাহিত্যের ‘অন্যতম প্রধান কবি’ উল্লেখ করে অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, “তার কবিতায় ব্যক্তি চেতনা মূর্ত হয়ে ওঠে। তিনি কবিতায় মানবিক সম্পর্কের কথা বলেছেন। তিনি বাংলাদেশের পাঠকের হৃদয়ে উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন।”

শ্রদ্ধা জানাতে আসা প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী কবি মাহবুবুল হক শাকিল বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও খরচে দেশে-বিদেশে আমাদের সবগুলো অফিস একসঙ্গে কাজ করে কবির মরদেহ দ্রুত দেশে আনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মনে করেন, আধুনিকতম এ কবির প্রয়াণ হলেও তিনি তার কবিতার মধ্যে বেঁচে থাকবেন।”

প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে শহীদ কাদরীর ছেলে আদনান কাদরী বলেন, “বাবা দেশে ফিরতে চাইতেন, নানা কারণে আসতে পারেননি। শেষ জীবনে ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও অসুস্থতার কারণে আসতে পারেননি।”

বাবাকে মূল্যায়ন করে তিনি বলেন, “বাবা নতুন করে লিখতে শুরু করেছিলেন। মৃত্যুর আগের দিনও তিনি কথা বলেছিলেন, তার চিন্তাশক্তি ছিল।”

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনি বলেন, “কবিতায় তিনি দেশ ও দেশের মানুষের কথা বলেছেন। অভিমান করে যে স্বদেশকে ছেড়ে গিয়েছিলেন, সেখানে তার ফেরার এ সময়ে এমন বিনম্র শ্রদ্ধাই তার প্রাপ্য।

“যা তিনি দিয়ে গেছেন, মানে তার কবিতা, এই শক্তিশালী সব কবিতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আমাদের অনুপ্রাণিত করবে।”

শুরুতে বেলা সোয়া ১১টায় ‘সমুখে শান্তি পারাবার, ভাসাও তরণী হে কর্ণধার’ গানে সুরের মধ্যে কবির মরদেহ রাখা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অস্থায়ী বেদিতে।

প্রায় দেড় ঘণ্টা সবার শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে নেওয়া হয় তার মরদেহ। সেখানে জানাজা শেষে বিকাল ৩টার দিকে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে অন্তিম শয়ানে রাখা হয় তাকে।