‘ইসলামী রাষ্ট্র একটি ভুল ধারণা’

বিভিন্ন ধর্মীয় ও উগ্রপন্থি গোষ্ঠীর ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে একটি ‘ভুল ধারণা’ বলে মন্তব‌্য করা হয়েছে জঙ্গিবাদবিরোধী এক আলোচনায়।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 August 2016, 05:52 PM
Updated : 31 August 2016, 02:33 AM

মঙ্গলবার ঢাকার একটি হোটেলে ‘ওয়ার অন টেরর ফর পিস’ বা ‘শান্তির জন্য জঙ্গিবিরোধী লড়াই’ শীর্ষক এই আলোচনা অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোক্তাদির চৌধুরী।

জঙ্গিদের ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণা নাকচ করে তিনি বলেন, ইসলামী রাষ্ট্র মানে অন্যের ওপর ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া, আর ইসলাম অন্যের উপর ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া সমর্থন করে না। মুসলমানদের মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে এটি কোনো নতুন বা সাময়িক সমস্যা নয় বলে মন্তব্য করেন উবায়দুল মোক্তাদির।

তিনি বলেন, “জঙ্গিবাদ কোনো নতুন বা সাময়িক সমস্যা নয়। যুগে যুগে এর অস্তিত্ব ছিল। ইসলামের খলিফা ওমর, উসমান ও আলীকে ক্ষমতার লোভে হত্যা করা হয়েছিল। হামলাকারীরা তখন ধর্মের অপব্যাখ্যা করে এসব কাজ করেছিল।

“এভাবে ইসলাম ধর্মে ক্ষমতার রদবদলে সন্ত্রাসের উপস্থিতি দেখা যায়। এর পেছনে দেখা যায় কোরআন ও ধর্মের অপব্যাখ্যা।”

গুলশান হামলাসহ বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি জঙ্গি হামলার ঘটনায় আলোচনায় আসা মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক যে জঙ্গি গোষ্ঠী ইরাক-সিরিয়ার একটি এলাকায় ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে, সেই আইএসসহ প্রচলিত চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলো ইসলামের মূল চেতনাবিরোধী বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের এই সংসদ সদস্য।

“আইএস ইসলামের মূল চেতনা থেকে বিচ্যুত। অনেকে মনে করতে পারেন ইসলামের মধ্যে সন্ত্রাসের বীজ। আমি অমনটি মনে করি না। ইসলামের নবী একমাত্র নবী যিনি ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। ঐশী বাণীতে বলা আছে- মোহাম্মাদের দায়িত্ব কেবল প্রচার করা, জোর জবরদস্তি নয়।”

জঙ্গিদের ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার অসারতা তুলে ধরে উবায়দুল মোক্তাদির বলেন, “ইসলামী রাষ্ট্র একটি ভুল ধারণা, কারণ ইসলামী রাষ্ট্র মানে অন্যের ওপর ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া, যেটা ইসলাম সমর্থন করে না।

“তবে হ্যাঁ, যেখানে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে তারা মিলেমিশে ধর্মের বিভিন্ন দিক চর্চা করতে পারে।”

জার্মানির নাৎসি বাহিনীসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে যেভাবে বামপন্থি শক্তিকে মোকাবেলা করা হয়েছিল বাংলাদেশেও একইভাবে জঙ্গিবাদের মোকাবেলা করা হচ্ছে বলে জানান সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ওবায়দুল মোক্তাদির।

“তালেবানপন্থিরা চুপচাপ বসে নেই। সরকারের ভেতরে কেউ কেউ থাকতে পারে, যারা মনে করতে পারে এদের সাথে সমঝোতা সম্ভব। কিন্ত আমি মনে করি না,” বলেন তিনি।

জঙ্গিরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটা ‘অন্যায় যুদ্ধ’ চাপিয়ে দিয়েছে মন্তব‌্য করে নিরপেক্ষতার ঊর্ধ্বে উঠে কঠোর হাতে তাদের দমনের কথা বলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।

তিনি বলেন, “এটা অস্বীকার করা যাবে না, জঙ্গি-সন্ত্রাসের একটা রাজনৈতিক মাত্রা আছে। জঙ্গিদের ধ্বংস করার পাশাপাশি তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদেরও ধ্বংস করতে হবে। যে আদর্শের ভিত্তিতে তারা চলছে তার অসারতা প্রমাণ করতে হবে।”

জঙ্গিবিরোধী অভিযানে গত ২৬ জুলাই রাজধানীর কল্যাণপুরের এক বাড়িতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ অভিযানে নয় জঙ্গি নিহত হয়। এছাড়া চলতি সপ্তাহে নারায়ণগঞ্জে এক অভিযানে গুলশান হামলার হোতা তামিম চৌধুরী দুই সহযোগীসহ নিহত হন।

এসব অভিযান নিয়ে বিএনপির প্রশ্ন তোলার প্রসঙ্গ টেনে তথ্যমন্ত্রী বলেন, একাত্তরের মতো এখনও একটি যুদ্ধ মোকাবেলা করছে দেশ।

“আমরা যুদ্ধের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। সুতরাং গুলি বুকে লাগল, না কি পেটে লাগল, তা দেখার সময় এখন নাই। যুদ্ধ যদি মনে করেন, নিরপেক্ষতার কোনো জায়গা নেই।”

সাম্প্রতিক জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িতদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শক্তির অংশ মনে করেন জাসদ সভাপতি ইনু।

আলোচনায় অংশ নেওয়া কয়েকজন জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পাশাপাশি সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার পক্ষে মত দেন।

তথ্যমন্ত্রী এই দুই প্রচেষ্টার পাশাপাশি জঙ্গিদের রাজনৈতিক আশ্রয়দাতাদেরও নির্মূল করার উপর গুরুত্ব দেন। 

“তাদের রাজনৈতিক মিত্র আছে, মিত্রদের ধ্বংস করা না গেলে জঙ্গি উৎপাদন বন্ধ হবে না। ক্রসফায়ারে নিহত জঙ্গিদের খালেদা জিয়া নিরাপরাধ বলছেন, অথচ তারা আত্মস্বীকৃত খুনি।”

গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের অভাবে জঙ্গিবাদের উদ্ভব হচ্ছে বলে কোনো কোনো মহলের দেওয়া এই বিশ্লেষণও সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন তথ‌্যমন্ত্রী ইনু।

“গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের কারণে জঙ্গিবাদের উদ্ভব হচ্ছে এমন বিশ্লেষণও সঠিক নয়। কারণ ইউরোপ- আমেরিকায় পূর্ণ গণতন্ত্র আছে, সেখানেও জঙ্গিবাদী কাজ হচ্ছে।”

সংসদ সদস্য আলী আশরাফ জঙ্গিবাদের বিস্তারে সমকালীন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটকেও দায়ী করেন।

“রাষ্ট্রগুলোর যুদ্ধের প্রবণতা বিশ্বের আরেকটি বড় সমস্যা। এর ফলেও জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দেয়।”

গত শতাব্দী ও চলতি শতাব্দীর বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে জঙ্গিবাদীদের রাষ্ট্রীয়ভাবেও আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার কথা বলেন সাংবাদিক-কলামনিস্ট সৈয়দ বদরুল আহসান।

তিনি বলেন, “রাষ্ট্রীয়ভাবেও যুগে যুগে জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে তালেবান যখন আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসে তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন, তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে গিয়েছিলেন।

“একুশে অগাস্টে গ্রেনেড হামলার পর তৎকালীন সরকার এর সুষ্ঠু তদন্ত না করে পানি ঢেলে আলামত নষ্ট করেছিল। উল্টো আরও জজ মিয়া নাটক সাজিয়েছিল। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে জামায়াত নেতাকে বসিয়েছিল। এর ফলে দেশের গ্রামে-গঞ্জে এখন সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে গেছে।”

বদরুল আহসান বলেন, “হাফিজ সাঈদের মতো একজন কুখ্যাত জঙ্গিকে পাকিস্তানে নায়ক বিবেচনা করা হয়। মিথ্যা অভিযোগ তুলে ইরাককে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য দায়ী বুশ ও টনি ব্লেয়ারকে বিচারের মুখোমুখি করা হয় না; উল্টো তাদেরকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। এভাবে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে অনেক সময় রাষ্ট্রও জড়িয়ে পড়েছে।”

হাফিজ সাঈদ পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ‘জামাত-উদ দাওয়া’র নেতা।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলায় ইংরেজি মাধ্যমের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জড়িত থাকার তথ‌্য বেরিয়ে এলেও মাদ্রাসাগুলো থেকে দৃষ্টি না সরানোর পরামর্শ দেন জ‌্যেষ্ঠ এই সাংবাদিক।

“বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে মনে করতে পারেন, কেবল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে জঙ্গিবাদ ছড়াচ্ছে। এমনটি ভাবলে ভুল হবে। দেশে শত শত মাদ্রাসা আছে যাদের পাঠ্যসূচি জঙ্গিবাদের সহায়ক হতে পারে। এসব সিলেবাস সময় উপযোগী করা প্রয়োজন।”

সেমিনারে জঙ্গিবাদকে রাজনৈতিক সমস্যা অভিহিত করে এটি নির্মূলে পরস্পরকে দোষারোপ না করে জঙ্গিবাদের মূলে যেতে হবে বলে মন্তব্য করেন বিএনপি নেত্রী শামা ওবায়েদ।

তিনি বলেন, “রাষ্ট্রীয়ভাবে দমন-নিপীড়ন, নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। সবাই মিলে সম্মিলিতভাবে জঙ্গিবাদ বন্ধ করতে হবে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বন্ধ করতে হবে।”

জঙ্গিবাদ সমস্যার সমাধানে গণতন্ত্র চর্চা আরও প্রসারিত করারও আহ্বান জানান দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে সংসদ থেকে ছিটকে পড়া দলটির এই তরুণ নেতা।

“সবাইকে ক্রসফায়ারে না দিয়ে দুই একজনকে জীবিত ধরেন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আরও তথ্য উদঘাটন করেন। ডেমোক্রেসির চর্চা আস্তে আস্তে বাড়ান, জঙ্গিবাদ আস্তে আস্তে কমে যাবে।”

দেশীয় সন্ত্রাসবাদের জন্য বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়ী করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত অলিউর রহমান।

তিনি বলেন, “দেশে সন্ত্রাসবাদের সূচনা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালে বেগম জিয়া জেএমবি, বাংলাভাইয়ের মতো জঙ্গি পুষেছিল।

“এরশাদও ক্ষমতায় থাকাকালে দেশের সেক্যুলার বৈশিষ্ট্যের অনেক ক্ষতি করে গেছেন। এভাবেই জঙ্গিবাদের পথকে মসৃণ করেছে রাজনৈতিক দলগুলো।”

আইএসের মতো খেলাফতপন্থি হিজবুত তাহরীরের বিষয়েও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো শুরুর দিকে উদাসীনতা দেখিয়েছিল বলে অভিযোগ করেন অলিউর রহমান।

“আজকের এই হিজবুত তাহরীরই মধ্যপ্রাচ্যের আইএস এর আদর্শের অনুসারী। গোয়েন্দাদেরকে আমার টেররিজম রিসার্স ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে আগেই সতর্ক করা হয়েছিল। হিজবুতের খেলাফত আর আইএসের খেলাফত একই বিষয়। কিন্তু গোয়েন্দারা তখন এটা উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল-এটা কিছুই না।”

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আব্দুস সেলিম বলেন, বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থার যা ক্ষতি হওয়ার তা ২০০১ সাল থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে হয়ে গেছে।

“আগে তরুণদের মধ্যে যে প্রবণতা দেখিনি এখন তা দেখা যাচ্ছে। এনএসইউর স্টুডেন্টরা আগে খোদা হাফেজ বললেও এখন সুন্দর করে আল্লাহ হাফেজ বলেছে। ফেইসবুকে যেভাবে ধর্মের প্রচারে পোস্ট দিচ্ছে প্রগতিশীলতা ও মুক্তচিন্তার পক্ষে সেভাবে লিখছে না।”

জঙ্গিবাদে যুক্ত হয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত তরুণদের বিষয়ে তাদের পরিবার জানত বলে মনে করেন অধ্যাপক সেলিম।

“সম্প্রতি জঙ্গিকর্মকাণ্ড করে যারা ধরা পড়ছে তাদের বাবা-মা বিষয়গুলো জানত। তারা বলছে, হ্যাঁ আমার ছেলে ধর্মের দিকে ঝুঁকেছিল, নিয়মিত মসজিদে যেত, কিন্ত তারা এ বিষয়ে তখন মোটেও উদ্বিগ্ন হয়নি। জঙ্গিরা বাড়ি ছাড়ার পরও তাদের অনেকে চুপ ছিল।”

সেমিনারে অন্যদের মধ্যে সাবেক রাষ্ট্রদূত নিম চন্দ্র ভৌমিক, অধ্যাপক আতাউর রহমান, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস এর প্রো-ভিসি নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বক্তব্য রাখেন।