কাসেমের রিভিউ রায় ট্রাইব‌্যুনালে

যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে আপিল বিভাগের দেওয়া রায় প্রকাশের পর তা পাঠানো হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব‌্যুনালে।  

সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 August 2016, 11:40 AM
Updated : 30 August 2016, 11:40 AM

এখন এই রায় ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে পাঠানো হবে কারাগারে। ফাঁসির আসামি কাসেমকে রায় পড়ে শুনিয়ে জানতে চাওয়া হবে, তিনি কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনার কথা জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না।

আদালতের সব বিচারিক প্রক্রিয়ার নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়ায় একাত্তরের বদর নেতা কাসেমের সামনে এখন কেবল ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগই বাকি।  

সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার মো. সাব্বির ফয়েজ (প্রশাসন ও বিচার) মঙ্গলবার বিকাল সোয়া ৫টায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে রায় প্রকাশের কথা জানান।

তিনি বলেন, “বিচারকদের স্বাক্ষরের পর রিভিউ রায় প্রকাশ করা হয়েছে। ২৯ পৃষ্ঠার এই রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়েছে।”

এরপর সুপ্রিম কোর্টের ডেপুটি রেজিস্ট্রার মেহেদী হাসান সন্ধ‌্যা সাড়ে ৬টার দিকে রায়ের অনুলিপি পৌঁছে দেন এ মামলার বিচারিক আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব‌্যুনালে। তার কাছ থেকে অনুলিপি বুঝে নেন ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার শহীদুল আলম ঝিনুক।

নিয়ম অনুযায়ী, ট্রাইব্যুনাল, কারা কর্তৃপক্ষ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য রায়ের তিনটি অনুলিপি ট্রাইব্যুনালে যায়। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও দুই পক্ষের আইনজীবীকেও অনুলিপি পাঠাতে হয়।

ট্রাইব‌্যুনাল ওই রায়ের আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কারা কর্তৃপক্ষকে আদেশ দেবে। আদেশে ট্রাইব‌্যুনালের বিচারকদের সই নিয়ে রায়ের কপিসহ পাঠানো হবে কারা কর্তৃপক্ষ, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ে।

এরপর কারা কর্তৃপক্ষ রায় ও আদেশ পাঠাবে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে। যুদ্ধাপরাধী কাসেম এখন সেখানেই আছেন।

তাকে রিভিউ খারিজের রায় ও আদেশ পড়ে শুনিয়ে প্রাণভিক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানতে চাইবে কারা কর্তৃপক্ষ।

দণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া সম্পর্কে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানিয়েছেন, কাসেম প্রাণভিক্ষা চাইলে তার দরখাস্ত রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের পরই দণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হবে।

কাসেম আবেদন না করলে, অথবা আবেদন করেও রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা না পেলে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কারা কর্তৃপক্ষ দণ্ড কার্যকর করবে। তবে তার আগে স্বজনেরা কারাগারে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে পারবেন।

মঙ্গলবার সকাল ৯টায় প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ কাসেমের রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়। 

এই বেঞ্চের বাকি চার সদস্য হলেন- বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান।

আপিল বিভাগের একই বেঞ্চ গত ৮ মার্চ মীর কাসেমের আপিলের রায় ঘোষণা করে। ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া প্রাণদণ্ডের সাজাই তাতে বহাল থাকে।

যে অভিযোগে প্রাণদণ্ড

অভিযোগ ১১: ১৯৭১ সালে ঈদুল ফিতরের পরের যে কোনো একদিন মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের কোনো এক অজ্ঞাত স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। তাকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ফলে জসিমের মৃত্যু হলে আরো পাঁচজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির লাশসহ তার মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।

# রিভিউ রায় লিখেছেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। এর সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন বেঞ্চের বাকি চার বিচারক।

# আপিলের রায়ে ১১ নম্বর অভিযোগে অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার দায়ে মীর কাসেমের ফাঁসির রায় বহাল থাকে। রিভিউ খারিজ হওয়ায় সেই দণ্ডই এখন তার প্রাপ্য।

# ৪, ৬ ও ১২ নম্বর অভিযোগ থেকে কাসেমকে খালাস দেয় আপিল বিভাগ। আর ২, ৩, ৭, ৯, ১০ ও ১৪ নম্বর অভিযোগে মোট ৫৮ বছরের কারাদণ্ড বহাল থাকে। রিভিউ আবেদনে ১১ নম্বর ছাড়া আর কোনো অভিযোগের বিষয়ে যুক্তি দেয়নি আসামিপক্ষ।

# রায়ে বলা হয়, মীর কাসেমের অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। তাকে দোষী সাব‌্যস্ত করার সিদ্ধান্ত বহাল থাকছে। রিভিউ আবেদন খারিজ করা হল।

ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মীর কাসেম ১৯৮৫ সাল থেকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ অর্থাৎ মজলিসে শূরার সদস্য হিসেবে দলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। ২০১২ সালের ১৭ জুন মতিঝিলে নয়া দিগন্ত কার্যালয় থেকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের বছর ৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার যুদ্ধাপরাধের বিচার।

এ মামলার শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ মীর কাসেমকে আখ্যায়িত করেছে পাকিস্তানের খান সেনাদের সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হওয়া ‘বাঙালি খান’ হিসাবে, যিনি সে সময় জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান, তা উঠে এসেছে ট্রাইব‌্যুনাল ও আপিল বিভাগের রায়ে।

একাত্তরে মীর কাসেমের নির্দেশেই চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিস সংলগ্ন এলাকায় হিন্দু মালিকানাধীন মহামায়া ভবন দখল করে নাম দেওয়া হয় ডালিম হোটেল। সেখানে গড়ে তোলা হয় বদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঘাঁটি এবং বন্দিশিবির। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণে সেই ডালিম হোটেলকে বলা হয় ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’।

সুপ্রিম কোর্ট ৬ জুন আপিলের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করলে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে, পরদিন তা পড়ে শোনানো হয় যুদ্ধাপরাধী কাসেমকে।

এরপর আইনে নির্ধারিত ১৫ দিন সময় শেষ হওয়ার আগেই গত ১৯ জুন আপিলের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেন মীর কাসেম। সেই রিভিউ আবেদনের ওপর ২৪ ও ২৮ অগাস্ট দুই দিন শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগ মঙ্গলবার রায় ঘোষণা করে। এর মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটে যুদ্ধাপরাধী কাসেমের বিচার প্রক্রিয়ার।