শহীদকে ঘরে ধরে রাখা যায় না

এই মুহূর্তে, এই দুঃসংবাদ, যদিও প্রত্যাশিত--তবু আমি ভীষণ ক্ষেপে আছি, এটা একেবারেই স্বতসিদ্ধ। যেহেতু প্রায় দেড় দশক দুই দশক ধরে এর জন্য প্রস্তুত ছিলাম। এবং ভেবেছিলাম যে, একদিন এই চূড়ান্ত দুঃসংবাদ পাবো, এর জন্য তৈরিও ছিলাম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, আসলে আমরা তৈরি থাকলেও, আমরা যারা নশ্বর মানুষ, তাদের পক্ষে এ রকম ঘটনা সহ্য করে নেওয়ার মতো কোনো রকম সামর্থ্য নেই।

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, জার্মানি প্রবাসী কবি-প্রাবন্ধিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 August 2016, 05:50 AM
Updated : 18 Nov 2020, 05:59 AM

যখনই এই খবর ফারুকের মধ্য দিয়ে পেলাম, ফারুক আমার ভাই স্বরূপ, আমি তখনই ফারুককে বললাম যে ফারুক, শক্তির বিয়োগ সংবাদ পেয়ে আমি একটা সনেট পাঠিয়েছিলাম, আজকে যদি তোমাকে একটা শোকগাথা পাঠাই, আমার মনে হলো আমি পারি, আমি শোকগাথা লিখতে পারবো, কিন্তু সেটা খুব আলঙ্কারিক হবে। এখন আমি যেটা বলতে চাই দু’চারটি কথা যে এই মুহূর্তে আমাদের শহীদ কাদরীর প্রতিভার মূল্যাঙ্কন করার সামর্থ‌্য আমার নেই। কিন্তু এইটুকু আমার মনে হয়, আমার ভীষণভাবে মনে হয়, গত কয়েক বছর ধরে যতদিন তাকে দেখিনি, সেই সময় অন্য একটা সান্নিধ্য গড়ে উঠেছিল, কি লিখছে কি না লিখছে। তো এখন ওর সবশেষ যেই বইটা যেটা প্রবাসে লেখা--আমার চুম্বনগুলি পৌঁছে দাও--সেটা আমার হাতে আসেনি। কে যেন টুইট করে জানিয়ে দিয়েছিল যে এই বইটা ২০০৯ সালে বেরিয়ে গেছে। 

এবং আমি ভাবছিলাম যে, এলিয়ট এক জায়গায় যেমন বলেছিলেন যে, প্রত্যেক কবি, প্রত্যেক মানুষ থেকে বয়সে বিলম্বিত, অনেক বড়। প্রত্যেক কবির ক্ষেত্রে এই কথাটা বলা যায় যে, তাদের এই মৃত্যু আমাদের বিবেকের সংবিতের পক্ষে খুব প্রয়োজনীয় একটা ঘটনা। 

মঁতেইগ যিনি পারসোনাল এসেস-এর প্রবক্তা ছিলেন তিনি বলেছিলেন, দার্শনিকতা করার মানে হচ্ছে, মৃত্যুকে কিভাবে আয়ত্ত করা যায় সেটা শিখে নেওয়া। এখানে একটা ঘরোয়া সেমিনারের মতো চলছিল। 

বুঝতে পারলাম, নশ্বরতার একটা কবিতার মন্ত্র আছে যা কবিতাকে সঞ্চালিত করতে পারে। 

আপাতত বলাই বাহুল্য যে, আমি এমন কোনো কথা বলব না যে-কথা কোনো বইয়ের, কোনো শোকলিপির উপক্রমনিকা হতে পারে। আমি সেটা বলবো না। 

আমি যেটা বলবো  যখন আমি প্রথম--সম্ভবত আটাত্তরে-- শহীদকে দেখি, কোলন শহরে, যেখানে জার্মান বেতার তরঙ্গ, সেখানে যখন দেখলাম তখন আমার যা মনে হয়েছিল তাহলো প্রথম দৃষ্টিপাতেই একটা অদ্ভুত বিদ্যুৎ বিহর ঘটে গেলো। সেটা হচ্ছে যে একদিক থেকে দেখছি ওকে। ঘুরে আমি চেয়ার নিয়ে আরেকদিকটায় বসলাম। আমি বুঝতে পারলাম ও নিজের মধ্যে প্রত্যেক কবির মতো অপূর্বভাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে আছে। একদিকে এই প্রথম আমাকে দেখবার এক অপূর্ব আনন্দ, অন্যদিকে, অন্যদিকে যেটা দেখলাম সেটা হলো সে কোনো বন্দিতে নির্মিত হওয়ার মতো মানুষ নয়, সে এক অদ্ভুত মানুষ-- শনাক্ত হতে চায় না। ইংরেজিতে বলবো ওয়ান হু ডাজন্ট ওয়ান্ট টু বি আইডেন্টিফাইয়েড।

এই যে দ্বিধাবিভক্ত রূপটা দেখেছিলাম, একদিকে অসামান্য লাজুক, অসামান্য সংবেদি, অন্যদিকে বিশ্ববাসী। ওই সময়টাতে আমি বুঝতে পেরেছিলাম ওকে কলকাতা বা ঢাকায় ধরে রাখা যাবে না। 

ও বেরিয়ে পড়লো। তারপরে লন্ডন, আমেরিকায় বেরিয়ে পড়লো। যদি তাকে দায়বিদ্ধ করি, আমি দায়বদ্ধ বলছি না, বলছি দায়বিদ্ধ করি যে তুমি কেন দেশের মাটিতে বসে লিখছ না। তাহলে আমাকেও তো দায়বিদ্ধ করতে হয়। আমি সময় তো দেশের মাটিতে থাকি না। কাজেই আমরা কি বলবো না প্রবাসী বাঙালি বলে কেউ নেই? 

বাঙালিরা চিরন্ত প্রবাসী। ওর ওই যে দ্বিধাবিভক্ত মুখাবয়ব, সেটা অপূর্ব লেগেছিল। 

সাঁচীর বুদ্ধ গুহা একদিক থেকে বৌদ্ধমূর্তিকে মনে হয় কাঁদছেন, অন্যদিক থেকে মনে হয় হাসছেন। আমরা তো সবাই দ্বিধাবিভক্ত।

সেজন্য আমি ওই লাইনটা লেখলাম, যে, এই যে প্রবাসের মধ্য থেকে আসলে ওর ভাষার একটা উন্মোচনও দাবি করছে। এবং যাখন আমার সাহস বাড়লো, যদিও আমার থেকে এক দশকের ছোট প্রায়। ওর তো জন্ম ১৯৪২ আমার ৩৩। আমার মনে হলো একটা অদ্ভুত কথা যে ও ভাষার শহীদ। এখন ভাষার শহীদ এইটা অনেকে বলবে খুব খারাপ বলেছি। এটা শব্দ নিয়ে জাদু খেলা খেললাম বলে মনে হবে-- তা নয় কিন্তু।  আমরা সবাই ভাষার শহীদ। এই যে আমরা কথা বলি, কথা বলবার যোগ্যতা অর্জন করলাম কারণ আমরা ভাষার শহীদ হতে চাই বলে। তার পরে কি হলো, আমি কলকাতায় যাই আসি। কবীর সুমনের স্বরলিপি এবং সুরে বেরুলো ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’।  তখন থেকে কলকাতায় অনেকেই ভাবে (এটা একটা নতুন তথ্য দিচ্ছি) যে শহীদ আর আমি এক শহরের নাগরিক। আমরা শুধু প্রতিবেশিই ছিলাম না, আমরা এক বাড়িতেই থাকতাম। আমাকে কলকাতায় মাঝে মাঝে লোকজন জিজ্ঞেস করে- কাদরীদা কেমন আছেন। এই ব্যাপারটা খুব মজা লেগেছে। এই ব্যাপারটা তোমাকে আমি যখন সম্বধন করে কথা বলছি, কোনোদিন তোমাকে দেখিনি, কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে ভাষার মধ্য দিয়ে তোমাকে সনাক্ত করছি। আশা করি আমাদের এই আত্মীয়তার বন্ধনটা অটুট থাকবে। 

আমি বলছি যে গত কয়েক বছর ধরে কলকাতায় কয়েকজন জিজ্ঞেস করে, কেউ না কেউ ভাবে ও বোধ হয় জার্মানিতেও থাকতো।  

আমি জানতে পারতাম কয়েকজনের মাধ্যমে ও কেমন আছে। আমি খবর নিতাম। 

এবং আরেকটা কথা হচ্ছে যে, যখন ওর ওই বইটাই--কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই--বেরুলো, এটা বোধ হয় ৭৮ সালে বেরুলো, তখনই আমি বুঝতে পারলাম একটা শব্দের তাৎপর্য। 

কবিরা একটা জায়গায় আত্মপ্রকাশের মাধ্যমে আত্মগোপন করে থাকে। ক্রন্দন না থাকলে কবিতা নেই। এবং সেই জায়গাটা আমরা রাখতে পারিনি বলে আমরা বাংলা ভাষার উপাসকেরা আমাদের আত্মপরিচয় হারিয়ে ফেলেছি। আমরা ক্রন্দনহীন হয়ে গেছি। 

এই লাইনটা বাংলা ভাষায় একটা প্রবাদ হয়ে গেছে--‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’। তার মানে হচ্ছে সব জায়গায় ক্রন্দন ছড়িয়ে আছে। মনে আছে রবীন্দ্র সঙ্গীত? 

“অশ্রুভরা বেদনা। দিতে দিতে জাগে।”

এইটের মধ্যে দিয়ে আজকে আমার অনুজ সতীর্থ সম্পর্কে আমার ভক্তি স্নেহ ব্যক্ত হয়ে উঠছে।  

[শহীদ কাদরীর মৃত্যুর খবরে ব্যথিত জার্মানি প্রবাসী কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সহকারী সম্পাদক রাজু আলাউদ্দীনকে জানিয়েছেন তার অনুভূতি। শ্রুতিলিখন: ফয়সাল আতিক]