মীর কাসেমের রিভিউ রায় মঙ্গলবার

যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডের চূড়ান্ত রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) যে আবেদন জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী করেছেন, তার রায় জানা যাবে মঙ্গলবার।

সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 August 2016, 06:46 AM
Updated : 28 August 2016, 06:46 AM

রোববার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুই দফায় প্রায় দুই ঘণ্টা রিভিউ শুনানির পর প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ রায়ের এই দিন ঠিক করে দেয়।

বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন- বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান।

মীর কাসেমের আবেদনে তারা কী সিদ্ধান্ত দেন, তা জানার অপেক্ষায় রয়েছে পুরো বাংলাদেশ। তেষট্টি বছর বয়সী জামায়াত নেতা মীর কাসেম এখন আছেন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারের কনডেম সেলে।

যুদ্ধাপরাধী কাসেমের শেষ আইনি সুযোগ এই রিভিউ আবেদন। এ আবেদনে রায়ের কোনো পরিবর্তন না হলে তার সামনে কেবল রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ থাকবে।

রিভিউ খারিজ হলে এবং তিনি প্রাণভিক্ষা না চাইলে কিংবা আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে কোনো বাধা থাকবে না।

যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতদের মধ্যে মীর কাসেমের আগে রিভিউ করে বিফল হয়েছিলেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মো. মুজাহিদ, মো. কামারুজ্জামান ও আব্দুল কাদের মোল্লা।

রিভিউ খারিজের পর তাদের সবার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। সর্বশেষ গত মে মাসে নিজামীর রিভিউ আবেদন খারিজের ছয় দিনের মাথায় তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।

মীর কাসেমের রিভিউ শুনানির পর আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, অভিযোগ ‘প্রমাণিত হয়নি’; কাসেমকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ‘উচিৎ হবে না’।

অন‌্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে অ‌্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, কাসেমের সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকবে বলেই তিনি আশা করছেন।

২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে মীর কাসেমকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর গত ৮ মার্চ আপিলের রায়ে ওই সাজাই বহাল থাকে। ৬ জুন পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর তা পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন‌্য ১৯ জুন আবেদন করেন মীর কাসেম।

রাষ্ট্রপক্ষ এরপর রিভিউ শুনানির দিন ধার্যের জন্য আবেদন করে। এর ধারাবাহিকতায় ২১ জুন চেম্বার বিচারপতি বিষয়টি নিয়মিত আপিল বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠান।

গত বুধবার আসামিপক্ষের সময়ের আবেদন নাকচ করে রিভিউ শুনানি শুরু করে আদালত। মীর কাসেমের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন তার বক্তব‌্য উপস্থাপন শুরু করার পর সেদিনের মত শুনানি মুলতবি করা হয়।

রোববার সকাল সাড়ে ৯টার পর আবার রিভিউ শুনানি শুরু হলে খন্দকার মাহবুব তার অসমাপ্ত বক্তব‌্য উপস্থাপন করেন। তার বক্তব‌্যের পর রাষ্ট্রপক্ষে ব্ক্তব‌্য উপস্থাপন শুরু করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। 

শুনানি চলার মধ‌্যেই বেলা ১১টায় আপিল বিভাগ বিরতিতে যায়। বিরতি শেষে ফিরে অ্যাটর্নি জেনারেল তার যুক্তি উপস্থাপন শেষ করলে আসামিপক্ষে খন্দকার মাহবুব আবারও তার যুক্তি আদালতের সামনে তুলে ধরেন। শুনানি শেষে বেলা সাড়ে ১২টার পর আদালত রায়ের জন‌্য ৩০ অগাস্ট দিন ঠিক করে দেয়। 

মীর কাসেম আলী

মীর কাসেম

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ জুন মতিঝিলে নয়া দিগন্ত কার্যালয় থেকে কাসেমকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের বছর ৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার যুদ্ধাপরাধের বিচার।

এ মামলার শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ মীর কাসেমকে আখ্যায়িত করেছে পাকিস্তানের খান সেনাদের সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হওয়া ‘বাঙালি খান’ হিসাবে, যিনি সে সময় জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান, তা উঠে এসেছে রায়ে।

একাত্তরে মীর কাসেমের নির্দেশেই চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিস সংলগ্ন এলাকায় হিন্দু মালিকানাধীন মহামায়া ভবন দখল করে নাম দেওয়া হয় ডালিম হোটেল। সেখানে গড়ে তোলা হয় বদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঘাঁটি এবং বন্দিশিবির। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণে সেই ডালিম হোটেলকে বলা হয় ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’।

ডালিম হোটেল ছাড়াও নগরীর চাক্তাই চামড়ার গুদামের দোস্ত মোহাম্মদ বিল্ডিং, দেওয়ানহাটের দেওয়ান হোটেল ও পাঁচলাইশ এলাকার সালমা মঞ্জিলে বদর বাহিনীর আলাদা ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্র ছিল সে সময়।

ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মীর কাসেম ১৯৮৫ সাল থেকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ অর্থাৎ মজলিসে শূরার সদস্য হিসেবে দলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। তিনি হলেন জামায়াতের পঞ্চম শীর্ষ নেতা, চূড়ান্ত রায়েও যার সর্বোচ্চ সাজার সিদ্ধান্ত এসেছে।

যে অভিযোগে প্রাণদণ্ড

অভিযোগ ১১: ১৯৭১ সালে ঈদুল ফিতরের পরের যে কোনো একদিন মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের কোনো এক অজ্ঞাত স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। তাকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ফলে জসিমের মৃত্যু হলে আরো পাঁচজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির লাশসহ তার মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।

ট্রাইব্যুনালে তিন বিচারকের ঐক্যমতের ভিত্তিতে এ অভিযোগে মীর কাসেমের ফাঁসির রায় হয়। আপিলেও তা বহাল থাকে। এছাড়া আরও ছয় অভিযোগে মোট ৫৮ বছরের কারাদণ্ডের রায় বহাল রাখে আপিল বিভাগ।

দুই পক্ষের যুক্তি

আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব শুনানিতে বলেন, সাক্ষীদের বক্তব্য অনুসারে তাকে ‘সর্বোচ্চ দণ্ড দেওয়ার সুযোগ নেই’।

“সেখানে বলা হয়েছে, ডালিম হোটেলে তিনি অনেকের মধ্যে একজন ছিলেন। অনেকের মধ্যে একজন হলে তাকে প্রিন্সিপাল অফেন্ডার বলা যায় না। সেক্ষেত্রে কীভাবে তাকে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া যেতে পারে? জসিমকে কোথায় হত্যা করা হয়েছে, চাক্ষুস সাক্ষীদের বক্তব্যে সেটা কোথাও নেই। তাহলে কীভাবে এই হত্যার জন্য তাকে ফাঁসি দেওয়া যেতে পারে?”

এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, “এ বিষয়গুলো আমরা বিবেচনা করেছি। আমরা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেইনি।

“আমরা একটা উপসংহারে এসেছি যে, একাত্তর সালে রাজাকার-আল বদর বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ড সেনাবাহিনীর হাতে থাকলেও ডালিম হোটেলের বিষয়টি ভিন্ন ছিল। মীর কাসেম আলী ওই সেন্টারের কমান্ডার ছিলেন। চট্টগ্রামে গুডস হিলেও (সাকা চৌধুরীর মামলা) সেনাবাহিনীর কমান্ড ছিল না। একটা (অভিযোগ) ছাড়া অন্যগুলোতে সেনাবাহিনী ছিল না।”

বেশ কয়েকজন সাক্ষীর সাক্ষ্য উপস্থাপন করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, “এই সব সাক্ষ্য দেখলেই বোঝা যাবে, তার (কাসেম) নির্দেশেই সব হয়েছে। অর্ধমৃত অবস্থায় তরুণ মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে যখন রুমের ভেতর ফেলে যাওয়া হয়, সেটা তার নির্দেশেই হয়েছে। একাধিক সাক্ষীর সাক্ষ্যে সেটা এসেছে।”

শুনানির পর মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “আসামিপক্ষ বলেছে, একটি চার্জের জন্য তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। অথচ সে যে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে হত্যা করেছে, এর কোনো চাক্ষুষ সাক্ষী নাই। আমি আদালতকে দেখিয়েছি, জসিম যে ডালিম হোটেলে বন্দি অবস্থায় ছিল, এটা প্রমাণিত।

“মীর কাসেম আলীর যে সেখানে সব নিয়ন্ত্রণ ছিল, জসিমকে যখন নির্যাকন করে ফেলে দেওয়া হয়, তখন সেখানে মীর কাসেম ছিলেন, তা শফিউল আলম ২ নম্বর সাক্ষ‌্যে বলেছেন। অন্য কয়েকজন সাক্ষী মীর কাসেমের উপস্থিতি ও অত্যাচার এবং জসিমকে ফেলে দেওয়া, সেই সময়ে তার উপস্থিতির বিষয়ে সবই বলেছেন।”

আসামিপক্ষ চাক্ষুষ সাক্ষী না থাকার কথা বললেও কাসেম যে সে সময় ডালিম হোটেলে বসানো পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্রের হর্তা-কর্তা ছিলেন, সেখানেই যে জসিমের মৃত‌্যু হয়েছিল- এসব তথ‌্য তারা নিজেরাও অস্বীকার করেননি বলে অ‌্যাটর্নি জেনারেল জানান। 

“যারা অত্যাচারিত হয়েছে, প্রক্যেকেই মীর কাসেম আলীর কথা বলেছে। ১২ নম্বর চার্জেও মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড হত, যদি ট্রাইব‌্যুনালের প্রসিকিউশন ঠিকমত মামলাটি পরিচালনা করত।”

অন‌্যদিকে খন্দকার মাহবুব শুনানির পর সাংবাদিকদের বলেন, যেসব সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে ওই অভিযোগ ‘প্রমাণিত হয়নি’। ওই অভিযোগে কাসেমকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ‘উচিৎ হবে না’।

“কোনো সাক্ষী বলেনি যে মীর কাসেম সরাসরি ওই হত্যাকাণ্ডের সময় উপস্থিত ছিলেন। আপিল বিভাগ বলেছে, সরাসরি কোনো প্রমাণ যদি পাওয়া না যায়, তাহলে ওই সময়ে প্রকাশিত বই-পত্র ছিল, তা পর্যালোচনা করে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে। 

“আমরা বলেছি, জসিমের মামতো বোন হিসাবে দাবি করে প্রসিকিউশনের ১৭ নম্বর সাক্ষী সাক্ষ‌্য দিয়েছেন, তিনি একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি ওই পত্রিকায় জসিমের কথা বলেন নাই। প্রসিকিউশন থেকে আরেকটা বই দেওয়া হয়েছে, অ্যাডভোকেট শফিউল আলম একটা দীর্ঘ বই লিখেছেন, সেখানেও জসিমের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। ”

খন্দকার মাহবুব বলেন, তারপরও আদালত যদি মনে করে যে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে, সেক্ষেত্রেও ৩০২ ধারায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ‘আইনগতভাবে উচিত হবে না’।

“আমাদর দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, যদি দেখা যায় যে আসামি অত্যন্ত দুর্ধর্ষ, একে ছেড়ে দিলে একই ধরনের অপরাধ করবে, সেক্ষেত্রে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু মীর কাসেম আলীকে যদি মৃত্যুদণ্ড নাও দেওয়া হয়, তাহলে তিনি এই ধরনের অপরাধ বাংলার মাটিতে করবেন- তেমন কোনো সম্ভাবনা নাই।

“তাই চরম দণ্ড দেওয়ার মূল বিষয় ‘অপরাধের পুনরাবৃত্তি’ এখানে নাই। মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার সময় আসামির চরিত্র দেখা হয়। মীর কাসেম আলী বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। সেবার ক্ষেত্রে ইবনে সিনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন হাসপাতাল করেছেন। গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত থেকে তিনি টিভির কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি সামাজিক কর্মকাণ্ডে ছিলেন।

“এই আসামির মনে যদি বিন্দুমাত্র কোনো আশঙ্কা থাকত, তাহলে এই মামলার যখন তদন্ত চলছিল, উনি বিদেশে গিয়েছেন, বিদেশ থেকে ফিরেও এসেছেন। এসব কিছু বিবেচনা করে, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিৎ হবে না।”