ট্রাইব্যুনাল সরাতে চিঠি জামায়াতের ষড়যন্ত্রের ফসল: শাহরিয়ার কবির

যুদ্ধাপরাধের বিচার বিলম্বিত করতে জামায়াতে ইসলামী নানা কৌশল নিচ্ছে মন্তব্য করে শাহরিয়ার কবির বলেছেন, সুপ্রিক কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ট্রাইব্যুনাল সরিয়ে নেওয়ার চিঠি তাদের ‘ষড়যন্ত্রের’ ফসল।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 August 2016, 04:00 PM
Updated : 27 August 2016, 05:13 PM

এজন্য প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে দুষছেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার। তার সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও সংস্কৃতি সংগঠক কামাল লোহানী।   

শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে শাহরিয়ার কবির বলেন, “জামায়াতের একটা কৌশল হচ্ছে যতোভাবে এটাকে (যুদ্ধাপরাধীদের বিচার) বিলম্বিত করা যায়। এর কারণ হচ্ছে জামায়াত আশা করছে, যে কোনও সময় একটা ‘মিরাকল’ ঘটবে, সরকারের পতন ঘটবে এবং যারা জেলখানায় আছে তারা বেরিয়ে আসবে। এই কৌশল নিয়ে জামায়াত এগোচ্ছে।

‘সর্বশেষ আমাদের কাছে অত্যন্ত ক্ষোভের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনাল সরিয়ে নিতে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে দেওয়া চিঠি।”

গত ১৮ অগাস্ট আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ওই চিঠিতে আগামী ৩১ অক্টোবরের মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে পুরনো হাই কোর্ট ভবন থেকে সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে।

তবে নিরাপত্তাসহ সব দিক বিবেচনায় ওই জায়গাই ট্রাইব্যুনালের জন্য ‘সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা’ মন্তব্য করে শাহরিয়ার বলেন, “এসব কিছু জামায়াতের ষড়যন্ত্রের ফসল।”

তিনি বলেন, “আমরা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করলাম প্রথমে দুটো ট্রাইব্যুনাল থাকলেও বর্তমান প্রধান বিচারপতি দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর একটা হয়ে গেল। আর সর্বশেষ হচ্ছে ট্রাইব্যুনালকে এখান থেকে চলে যেতে হবে।”

যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলী তার বিচার শুরুর আগেই যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধে তদবির চালানোর জন্য ২০১১ সালে ২৫ মিলিয়ন ডলার দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ক্যাসেডি অ্যান্ড এসোসিয়েটস নামের একটি লবিং ফার্মকে নিয়োগ করেছিলেন বলে দাবি করেন তিনি।

সম্মেলনে অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বলেন, সুপ্রিম কোর্ট সড়ক ভবনের যে জায়গাটি নিয়েছে তার আয়তন সুপ্রিম কোর্ট নতুন ভবনের আয়তনের প্রায় সমান।

“বিচারের এজলাস বসার জায়গা নেই বলে এটা নেওয়া হলেও সেখানে এখন সেলুন, বিউটি পার্লার, জিমনেসিয়াম, ব্যাঙ্কোয়েট হল ও থাকার জায়গা।

“তাহলে আমাদের ধরে নিতে হবে, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের চেয়ে বিউটি পার্লার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটাই যদি ধারণা দেওয়া হয় তাহলে এর থেকে লজ্জার ও দুঃখের বিষয় বাংলাদেশে আর কিছু হতে পারে না।”

তাই যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল সরিয়ে নিতে সুপ্রিম কোর্টের স্থান সংকুলানের বিষয়টি ‘সঠিক নয়’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, “যুদ্ধাপরাধীর বিচার এখনও শুরুর পর্যায়ে। এখনও হাজার হাজার যুদ্ধাপরাধীর বিচার বাকি রয়ে গেছে।”

কয়েক মাস আগে অবসরে যাওয়া আপিল বিভাগের এই বিচারপতি বলেন,“আমার তিনটি রিভিউ (যুদ্ধাপরাধ মামলার) শোনার সুযোগ হয়েছিল, তখন বার বার একটি কথা আমার মনে হয়েছে মূল নেতাদের বাইরে স্থানীয়ভাবে আরও অনেক রাজাকার ও যুদ্ধপারাধী ছিল যাদের নাম বার বার আসছে। কতগুলো নাম আমার এখনো মনে আছে- বগাবুড়া, মুসা, ডাক্তার কাদের, এমনকি মিরপুরের সাবেক সাংসদ খালেকের নামও বহুবার আসছে।”

এদের কেন বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না তা নিয়ে বারবার প্রশ্ন এসেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এদের অপরাধও নেতৃস্থানীয় রাজাকারের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। এ ধরনের কয়েক হাজার অপরাধী এখনও রয়ে গেছে। আমরা আশা করেছিলাম, আরও ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে।

“সেখানে এখন ট্রাইব্যুনালকে বন্ধ করে দেওয়ার চক্রান্ত হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “প্রধান বিচারপতি ২০১৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর প্রকাশ্য আদালতে স্বীকার করেছেন, তিনি নিজেও একাত্তরে শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। সুতরাং যে ব্যক্তি নিজেই রাজাকার ছিলেন তিনি রাজাকারদের বিচার চাইবেন এটাতো হতে পারে না।”

কামাল লোহানী বলেন, “বিদেশে মীর কাশেম যে টাকা ছড়িয়েছে, তা দেশেও কিন্তু কম ছড়ায়নি। তার প্রমাণ হিসেবে এ ধরনের ঘটনাগুলো ঘটে যাচ্ছে।”

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে এ সংবাদ সম্মেলনে সাবেক বিচারপতি শামসুল হুদা, শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, বীরাঙ্গনা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী ও মহিলা সমিতির সভাপতি আয়শা খানমসহ আরও অনেকে বক্তব্য রাখেন।

প্রধান বিচারপতিকে খোলা চিঠি

সংবাদ সম্মেলনে প্রধান বিচারপতির উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠি  পড়ে শোনান শাহরিয়ার কবির।

“মাননীয় প্রধান বিচারপতি, আপনি ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি যখন প্রধান বিচারপতির দায়িত্বগ্রহণ করেন আমরা বর্তমান সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। কারণ সংখ্যালঘু ধর্মীয় ও জাতিসত্যার একজন হিসেবে আপনার এ নিয়োগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের দায়বদ্ধতার অভিব্যাক্তির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অংগনেও বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি উজ্জল করেছিল।

“আমরা আশা করেছিলাম সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে এবং সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে আপনিও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি দায়বদ্ধ থাকবেন এবং সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক যা কিছু আছে তা অপসারণে উদ্যোগী হবেন। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেহতনা বিরোধী ধারা যা বাংলাদেশে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে উৎসাহিত করেছে, সেসব অপসারণের ক্ষেত্রে আপনার উদ্যোগহীনতা আমাদের আশাহত করেছে।

“৭১ এর গণহত্যাকারী ও মানবতাবিরোধীদের চলমান মামলার আপিল ও রিভিউ শুনানিতে আপনার কিছু মন্তব্য ৭১ এর গণহত্যাকারীদের উৎসাহিত করেছে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের বিচারের মান ক্ষুণ্ন করেছে।

“আপনি গণহত্যাকারী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলা চলাকালে তার আত্ময়দের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং কথা বলেছেন, যা আপনি স্বীকারও করেছেন। এ বিষয়ে দৈনিকে জনকন্ঠ প্রতিবেদন প্র্রকাশ করলে আপনি ওই পত্রিকাকে শাস্তি দিয়েছেন, যা আমাদের বিবেচনায় ন্যায় বিচারের পরিপন্থী। যেহেতু জনকন্ঠের রিপোর্ট ছিল আপনার বিরুদ্ধে ওই মামলায় আপনার এজলাসে না থাকা ছিল বাঞ্ছনীয়। কিন্তু তা হয়নি।

“গণহত্যাকারী কামারুজ্জামানের মামলার শুনানীর এক পর্য়ায়ে প্রকাশ্য আদালতে প্রধান বিচারপতির আসনে বসে স্বীকার করেছেন ৭১ এ আপনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অন্যতম সহযোগি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। ৭১ এর শান্তি কমিটি গঠনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিল জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ। যে দলের নেতাদের ৭১ এ গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য আপনার আদালতে বিচার হচ্ছে।

“আপনার প্রতি আমাদের বিনীত প্রশ্ন, ৭১ সালে আপনি যে অপরাধী দলের সদস্য ছিলেন, সে দলের নেতাদের বিচারে আপনার বিচারক থাকা কতটা আচরণ বিধি ও নৈতিকতার সয্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ?

“আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আইনে আপিলের রিভিউর কোনও বিধান না থাকলেও আপনাদের ক্ষমতাবলে অভিযুক্তদের রিভিউর সুযোগ দিয়েছেন। যা আন্তর্জাতিক অংগনে আমাদের বিচারের মান বৃদ্ধি করলেও রিভিউর নামে গণহত্যাকারীদের মৃত্যুদন্ড মাসের পর মাস বিলম্বিত হওয়ায় ৩০ লক্ষ্য শহীদ পরিবারসহ বিচার প্রত্যাশী গোটা জাতী হতাশ ও ক্ষুদ্ধ হযেছে। এই বিচার চলাকালেও শহীদ পরিবারের বহু সদস্য গণহত্যাকারীদের শাস্তি না দেখে মৃত্যুবরণ করেছেন। যা আমাদের জন্য অত্যন্ত  বেদনাদায়ক।

“আমরা আশা করেছিলাম আপনি প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার আরও গতিশীল হবে। কারণ এটা নিছক ৭১ এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিচার নয়, ৩০ লক্ষ্য শহীদের প্রতি গোটাজাতির দায়িত্ববদ্ধতাও বটে। আপনি এই বিচারকার্য়্যকে কতটা গুরুত্বহীন মনে করেন তার সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে ৩১ অক্টোবরের ভেতর পুরনো হাইকো্র্ট ভবন থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সরিয়ে দেয়ার নোটিশ।”